আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেরই একজন স্থায়ী বাসিন্দা, কিন্তু কর্মস্থল চট্টগ্রাম ইপিজেড-এর বেপজা পাবলিক স্কুল ও কলেজে হওয়ায় দিনের ব্যস্ততায় প্রিয় ক্যাম্পাসে খুব একটা ঘুরে বেড়ানো হয় না। সেদিন ছিল ১২ই জুলাই, ২০২৫, শনিবার। সকাল আনুমানিক এগারোটা। ২নং রাস্তা ধরে আনমনে হেঁটে স্কুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখ আটকে গেল চিরচেনা সেই গেটে, ধুলোমাখা পথে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সময় যেন পিছিয়ে গেছে, শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলো একসাথে জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছে। যে প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আমরা বন্ধুরা এখনো দেশ-বিদেশে গর্ব করি, তার প্রতি এই গভীর ভালোবাসা থেকেই আজকের কিছু ভাবনা তুলে ধরছি।
এই নামটি আমাদের কাছে কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম নয়, এটি একটি আভিজাত্য, একটি গৌরবের উত্তরাধিকার। আমার স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করছে ১৯৯১ সালের সেই দিনগুলোর কথা। আমি এই কলেজ থেকেই এইচএসসি পাস করেছি। সেবার কুমিল্লা বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম ২০ জনের মধ্যে আমরা এই কলেজেরই প্রায় ৭-৮ জন বন্ধু স্থান করে নিয়েছিলাম! এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না; প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পর পত্রিকার পাতায় আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটা গর্বের সাথে উচ্চারিত হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা সব প্রফেসরদের ছেলেমেয়েরা ছিল আমাদের সহপাঠী। তাঁদের জ্ঞান, মেধা আর স্বপ্নের আদান-প্রদান দেখে আমরাও বড় হওয়ার সাহস পেতাম। এই সুদৃঢ় ভিত্তিই আমাদের শিখিয়েছিল আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে।
সেই সোনালী অতীতের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যখন বর্তমানকে দেখি, তখন একজন শুভানুধ্যায়ী হিসেবে কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। সেদিন বড় মেয়ের কাছে জানলাম, এবারের এসএসসির ফলাফলে বিজ্ঞান বিভাগের ৩৪ জন ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের মাত্র ১ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেলেও মানবিক বিভাগ থেকে সেরূপ কোনো সাফল্য আসেনি। আমাদের সময়ে তিনটি বিভাগেই সমান তালে প্রতিযোগিতা হতো। এই ভারসাম্যটা হয়তো এখন আগের মতো নেই। আবার গত বছর এক বন্ধুর ছেলের ভর্তির অভিজ্ঞতায় দেখলাম, ছেলেটি বিজ্ঞানে পড়তে চাইলেও অনলাইন আবেদনের কোনো এক পদ্ধতিতে তাকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনাটি আমাকে ভাবিয়েছিল। আমাদের সন্তানেরা যেন তাদের আগ্রহ এবং মেধা অনুযায়ী সর্বোত্তম বিভাগে পড়ার সুযোগ পায়, সেই পথটি আরও মসৃণ করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।
একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণশক্তি তার শিক্ষার্থীরা, আর তার আত্মা হলেন শিক্ষকেরা ও অভিভাবকতুল্য নেতৃত্ব। আমাদের সময়ে শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ জাকির উল্লাহ স্যার আর প্রধান শিক্ষক খাইরুল আলম স্যারের প্রকাণ্ড ছায়া ছিল আমাদের জন্য এক বিশাল আশ্রয়। তাঁদের রাশভারী কণ্ঠস্বর, করিডোরে হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গি, কিংবা অ্যাসেম্বলিতে দেওয়া একেকটি ভাষণ আমাদের জন্য ছিল অবশ্য পালনীয় নির্দেশ। তাঁরা শুধু প্রশাসক ছিলেন না, ছিলেন সত্যিকারের অভিভাবক। তাঁদের অবসরের পর প্রতিষ্ঠানটি যেন সেই নিবিড় অভিভাবকত্ব কিছুটা হারিয়েছে। এই সত্যটি আমি নিজে উপলব্ধি করেছি একজন অভিভাবক হিসেবে। গত জুন মাসে আমার দুই মেয়ের বেতন স্লিপ জমা দিতে স্কুল অফিসে গিয়েছিলাম। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে সেই ঐতিহাসিক সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গিয়েছিলাম অধ্যক্ষ মহোদয়ের কক্ষের দিকে। কিন্তু গিয়ে দেখি চেয়ারটি শূন্য। মনটা ভারাক্রান্ত হলো। শুনলাম, অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকের মতো দুটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পদে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে কেউ নেই। এই অভিভাবকত্বের জায়গাটি পূর্ণ হলে পুরো প্রতিষ্ঠানে নিঃসন্দেহে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হবে।
ক্যাম্পাসের প্রাণবন্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আরও কিছু বিষয়ে নজর দেওয়া যেতে পারে। আমাদের সময়ে ইলিয়াছ ভাইয়ের ছোট্ট লাইব্রেরি আর তার সামনের চত্বরটা ছিল আমাদের প্রাণকেন্দ্র। এখনকার শিক্ষার্থীদেরও এমন সুন্দর স্থান প্রয়োজন। আমি একজন অভিভাবক হিসেবে দেখেছি, অনেক শিক্ষার্থী টিফিনের সময় বা ক্লাসের ফাঁকে বাইরে চলে যায়। ক্যাম্পাসের ভেতরে যদি একটি মানসম্মত ক্যান্টিনের ব্যবস্থা থাকত, যেখানে স্বাস্থ্যকর টিফিনের পাশাপাশি খাতা, কলম, পেন্সিলের মতো প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ পাওয়া যেত, তাহলে শিক্ষার্থীদের স্কুল টাইমে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হতো না। এতে করে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাও অনেকাংশে কমে আসত। ক্যাম্পাসের আইন অনুষদের বিপরীতে মার্কেটে স্কুল ইউনিফর্ম পরা কিছু শিক্ষার্থীকে আড্ডা দিতে দেখে মনে হয়েছে, তাদের স্কুল প্রাঙ্গণেই যদি ব্যস্ত রাখার মতো সুন্দর ব্যবস্থা থাকত, তবে দৃশ্যপট ভিন্ন হতে পারত।
এর জন্য প্রয়োজন সহ-শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা। আমাদের সময়ে চারটি হাউসে ভাগ হয়ে ফুটবল খেলা, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। এই ঐতিহ্য এখনো আছে, যা প্রশংসার যোগ্য। তবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এর পরিধি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলা ও ইংরেজিতে বিতর্ক ক্লাব, রচনা ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞান ও কোডিং প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বছরব্যাপী ব্যস্ত রাখা সম্ভব। বিভিন্ন ক্লাব গঠন করে তাদের হাতেই দায়িত্ব দিলে তারা যেমন শিখবে, তেমনি তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কাজে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি নান্দনিক পরিবেশেরও খুব প্রয়োজন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, টিফিন পিরিয়ডে আমরা স্কুলের ছোট মাঠটায় দৌড়ে বেড়াতাম। সেই মাঠটি আরও প্রশস্ত করে খেলাধুলার উপযোগী করা যেতে পারে। ক্যাম্পাসে একটি সবুজ বাগান তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে থাকবে বাহারি ফুলের গাছ ও বিভিন্ন ঔষধি গাছ। শিক্ষার্থীরা সেই গাছের সাথে পরিচিত হবে, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখবে এবং এর সৌন্দর্য উপভোগ করবে। অবকাঠামোগত এই শূন্যতার মধ্যেই অবশ্য এক ঝলক আশার আলো দেখিয়েছে নতুন একাডেমিক ভবনের নির্মাণকাজ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমাদের জোর দাবি, এই ভবনের কাজ দ্রুত শেষ করে এটিকে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, আধুনিক বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার ল্যাব, শিক্ষার্থীদের কমনরুম ও ক্লাসরুমসহ স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলা হোক।
এইসব স্বপ্নের কথা বলছি কারণ আমি জানি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে কতটা আন্তরিক। তাঁদের সাম্প্রতিক স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিটি আমাদের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে। এই দূরদর্শী উদ্যোগগুলোর জন্য বর্তমান প্রশাসনকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানাই।
শেষ করছি আমার ব্যক্তিগত এবং গভীর এক অনুভূতি দিয়ে। একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমার স্মৃতি যেমন এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ইট-পাথরে মিশে আছে, তেমনি একজন অভিভাবক হিসেবে আমার দুই মেয়ের ভবিষ্যৎও এর প্রতিটি ক্লাসরুমের সাথে জড়িয়ে গেছে। আমি স্বপ্ন দেখি, আমার মেয়েরা একদিন এই প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত জ্ঞান, সম্মান আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে; তারাও তাদের সন্তানদের কাছে এই স্কুলের গল্প শোনাবে ঠিক তেমন গর্বের সাথে, যেমনটা আমি করি।
তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমার এই আবেদন কোনো সাধারণ অনুরোধ নয়, এটি একজন প্রাক্তন ছাত্রের গভীর ভালোবাসার এবং একজন উদ্বিগ্ন বাবার ভবিষ্যতের স্বপ্ন রক্ষার আকুতি। আপনারা শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এবং নতুন ভবন তৈরি করে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি শরীর ও তাতে রক্তমাংস তৈরি করেছেন—আপনাদের এই আন্তরিক ও দূরদর্শী পদক্ষেপ আমাদের আশান্বিত করে। এখন এই শরীরকে পথ দেখানোর জন্য, তাকে সজীব ও সচল রাখার জন্য একটি মস্তিষ্ক (একজন সুযোগ্য অধ্যক্ষ) ও একটি হৃদপিণ্ড (একজন স্নেহশীল প্রধান শিক্ষক) যোগ করে দিন।
আপনাদের এই একটি চূড়ান্ত পদক্ষেপই পারে আপনাদের অন্যান্য সকল মহৎ উদ্যোগকে সফল করতে। আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের সন্তানদের জন্য তাদের প্রিয় স্কুলটিকে আবার সেই আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিই—যেখানে থাকবে জ্ঞানের পাশাপাশি খেলাধুলা, বিজ্ঞানের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য, এবং কঠোর শাসনের পাশাপাশি বাবার মতো অকৃত্রিম স্নেহ ও মায়ের মতো নিবিড় পরিচর্যা।