মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনা: জাতির কফিনে শেষ পেরেক?

উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের ওপর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে পাইলটসহ অন্তত ৩১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৫ জনই কোমলমতি শিশু। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি একটি অশনিসংকেত—আমাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়াবহ এক প্রশ্নচিহ্নের নাম। যে যুদ্ধবিমান দেশের মানুষকে রক্ষা করার কথা, আজ তা-ই নিজ দেশের ফুলের মতো শিশুদের রক্তে রঞ্জিত হলো।

এই এফ-৭ বিমানগুলো মূলত চীনের চেংডু জে-সেভেন ফাইটার জেটের বাংলাদেশি সংস্করণ। তথ্য অনুযায়ী, চীন নিজেই এই বিমানের উৎপাদন ২০১৩ সালে চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে এবং ২০২৩ সালে তাদের বিমানবাহিনী থেকে এটিকে স্থায়ীভাবে অবসরে পাঠিয়েছে। অর্থাৎ, যে বিমান তার নিজ দেশেই বাতিল, তা দিয়েই চলছে আমাদের আকাশ রক্ষার মহড়া।

ইউরেশিয়ান টাইমসের সূত্রমতে, বাংলাদেশ ২০১৩ সাল পর্যন্ত চীনের কাছ থেকে মোট ১৬টি এফ-৭ বিজিআই ভ্যারিয়েন্টের বিমান কিনেছিল। এর আগেও এই মডেলের বিমান কেনার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু এই বিমানগুলো যেন একেকটি উড়ন্ত মৃত্যুফাঁদ। আসুন, আমরা পেছনে ফিরে তাকাই:
প্রথম ঘটনা (২০০৫): উত্তরার ফায়েদাবাদে একটি এফ-৭ বিমান বিধ্বস্ত হয়। সৌভাগ্যক্রমে সেবার কেউ নিহত না হলেও চারজন আহত হয়েছিলেন। সেদিনই হয়তো আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
দ্বিতীয় ঘটনা (২০০৮): টাঙ্গাইলে একটি এফ-৭ বিধ্বস্ত হয়ে পাইলট মোরশেদ হাসান নিহত হন। অভিযোগ রয়েছে, তার প্যারাসুটটি ঠিকমতো কাজ করেনি।
তৃতীয় ঘটনা (২০১৫): বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয় আরেকটি এফ-৭ বিমান। এর পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদের দেহটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাগরতলেই হারিয়ে যান দেশের এক তরুণ পাইলট।
চতুর্থ ঘটনা (২০১৮): আবারও টাঙ্গাইলে বিধ্বস্ত হয় একটি এফ-৭। ফুয়েল ট্যাংকে আগুন ধরে যাওয়ায় উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দীপু আর ফিরে আসতে পারেননি।

আগের চারটি দুর্ঘটনার একটিও লোকালয়ে বিধ্বস্ত না হওয়াকে হয়তো ‘মন্দের ভালো’ বলে সান্ত্বনা দেওয়া যেত। কিন্তু এবার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এবার শিকার হলো আমাদের শিশুরা। মাইলস্টোন স্কুলের ওপর ভেঙে পড়া বিমানটি শুধু পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামকেই কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

এখন প্রশ্ন হলো, বাকি বিমানগুলোর কী হবে? এই বহরে তো এখনও প্রায় ডজনখানেক বা তার বেশি এফ-৭ বিমান রয়ে গেছে। এরপর উনারা কোথায় বিধ্বস্ত হবেন? আমাদের কোন স্কুল, কোন আবাসিক এলাকা পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু?

মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ যেমন বিষ, মেয়াদোত্তীর্ণ যুদ্ধযান তেমনি আত্মঘাতী। ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান—আমাদের প্রতিবেশীরা নিরাপত্তার স্বার্থে বহু আগেই এই জে-সেভেন বিমান বাতিল করে দিয়েছে। অথচ আমরা এখনও এই বাতিল লোহালক্কড়ের মহড়া দিয়ে চলেছি।

এইসব বিমান দিয়ে আমরা কীসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি? যাদের হামলায় নিজ দেশের মানুষই মারা যাচ্ছে, তারা কি আসলেই আমাদের রক্ষক? আর কত অপঘাতে মৃত্যুর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে?

আজ খোলা বইয়ের পাতায় প্রশ্ন রেখে গেলাম—এই মৃত্যুর মিছিলের দায়ভার কে নেবে? আর কবে আমাদের নাগরিকদের জীবনের মূল্যে কেনা এই মৃত্যুফাঁদগুলো আকাশ থেকে নামানো হবে?

About kholaboi

Check Also

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ২৪ জুলাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত

অনিবার্য কারণবশত চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২০২৫ সালের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Skip to toolbar