
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুটি পৃথক সিদ্ধান্তে প্রাথমিক, নিম্ন-মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রতিটি শ্রেণীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আসুন, সহজ কথায় এই উদ্যোগের প্রতিটি দিক বিস্তারিতভাবে জেনে নিই এবং এর পেছনের কারণ ও ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করি।
নতুন সিদ্ধান্তটি আসলে কী?
সরকারের নতুন এই নীতিমালায় দুটি প্রধান স্তরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে:
মাধ্যমিক ও নিম্ন-মাধ্যমিক স্তর (স্কুল)
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি শাখায় (section) সর্বোচ্চ ৫৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে। এর বেশি শিক্ষার্থী থাকলে নতুন শাখা খুলতে হবে।
- কেন এই সিদ্ধান্ত? মূলত শ্রেণীকক্ষে অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর চাপ কমানো এবং শিক্ষক যেন প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি আলাদাভাবে মনোযোগ দিতে পারেন, তা নিশ্চিত করাই এর প্রধান লক্ষ্য। একটি সুশৃঙ্খল ও কার্যকর শিখন-শেখানো পরিবেশ তৈরি করা এই সিদ্ধান্তের মূল উদ্দেশ্য।
প্রাথমিক স্তর
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী) শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এখানে আদর্শ অনুপাত ধরা হয়েছে ৩০:১। অর্থাৎ, প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য কমপক্ষে একজন শিক্ষক থাকবেন।
- কেন এই অনুপাত? শিশুদের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য এই স্তরে শিক্ষকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। কম শিক্ষার্থী থাকলে শিক্ষক প্রত্যেক শিশুকে আলাদাভাবে যত্ন নিতে পারেন, যা তাদের মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশে সহায়তা করে।
বাস্তব প্রেক্ষাপট ও উদাহরণ
এই সিদ্ধান্তটি সারা দেশের স্কুলগুলোতে দুই ধরনের চিত্র তৈরি করবে।
উদাহরণ ১: শহরের নামকরা স্কুল
ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ বা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, এক একটি শাখায় ৭০ থেকে ৮০ জন, এমনকি তারও বেশি শিক্ষার্থী ক্লাস করে। ফলে শিক্ষকের পক্ষে সবাইকে সমানভাবে দেখাশোনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। নতুন ৫৫ জনের নিয়মটি কার্যকর হলে এই স্কুলগুলোকে হয় নতুন শাখা খুলতে হবে, নয়তো ভর্তির সংখ্যা কমাতে হবে। এর ফলে ভর্তির প্রতিযোগিতা আরও বাড়তে পারে, তবে যারা সুযোগ পাবে, তারা নিঃসন্দেহে একটি উন্নত পরিবেশে পড়াশোনা করার সুযোগ পাবে।
উদাহরণ ২: গ্রামের বা মফস্বলের স্কুল
অন্যদিকে, অনেক গ্রামীণ বা মফস্বলের স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক কম। কিছু কিছু স্কুলে একটি শ্রেণীতে ১০-১৫ জনের বেশি শিক্ষার্থীই পাওয়া যায় না। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের প্রায় ১০ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ জনেরও কম। এসব ক্ষেত্রে ৩০:১ অনুপাত বাস্তবায়ন করা গেলে সেখানকার শিক্ষার্থীরা আরও নিবিড় পরিচর্যা পাবে। আবার, কম শিক্ষার্থীর স্কুলগুলোকে পার্শ্ববর্তী স্কুলের সাথে একীভূত করার যে নীতি নেওয়া হয়েছে, তা কার্যকর হলে শিক্ষক ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
ইতিবাচক ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ
যেকোনো সরকারি সিদ্ধান্তের মতোই এরও কিছু ভালো দিক এবং কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
ইতিবাচক দিকসমূহ (Pros)
- শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি: কম শিক্ষার্থী থাকায় শিক্ষকরা হাতে-কলমে শেখানো, দলীয় কাজ করানো এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দুর্বলতা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
- শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুসম্পর্ক: শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম হলে তাদের সাথে শিক্ষকের একটি ব্যক্তিগত ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়, যা শেখার প্রক্রিয়াকে আনন্দদায়ক করে তোলে।
- কার্যকর পাঠদান: শিক্ষকের পক্ষে ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয় এবং পাঠদানে নতুন নতুন কৌশল (যেমন: মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার) প্রয়োগ করা সম্ভব হয়।
- শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ: অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী হীনম্মন্যতায় ভোগে বা প্রশ্ন করতে ভয় পায়। ছোট ক্লাসে তারা নিজেদের প্রকাশ করার সুযোগ বেশি পায়, যা তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ (Challenges)
- ভর্তি সংকট: বড় শহরগুলোতে ভালো স্কুলে ভর্তির চাপ আরও বাড়তে পারে। সীমিত আসনের কারণে অনেক শিক্ষার্থী হয়তো কাঙ্ক্ষিত স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাবে না।
- অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা: নতুন শাখা খোলার জন্য অতিরিক্ত শ্রেণীকক্ষ, বেঞ্চ এবং অন্যান্য সরঞ্জামের প্রয়োজন হবে। অনেক স্কুলের পক্ষেই রাতারাতি এই ব্যবস্থা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
- শিক্ষক সংকট: নতুন শাখা খুললে অতিরিক্ত শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। বিশেষ করে গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোতে যোগ্য শিক্ষকের সংকট থাকায় এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
- ব্যয় বৃদ্ধি: বেসরকারি স্কুলগুলোর আয় অনেকাংশে শিক্ষার্থীর বেতনের উপর নির্ভরশীল। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেঁধে দেওয়ায় তাদের আয় কমতে পারে, যা স্কুলের সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
ভবিষ্যৎ ভাবনা ও করণীয়
এই সিদ্ধান্তটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে কিছু বিষয়ের উপর নজর দেওয়া জরুরি:
১. অবকাঠামো উন্নয়ন: সরকারের পক্ষ থেকে স্কুলগুলোতে নতুন শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ এবং অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।
২. শিক্ষক নিয়োগ: দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া এবং তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
৩. ডাবল শিফট চালু: যেসব স্কুলে অবকাঠামোগত সংকট রয়েছে, সেখানে সাময়িকভাবে ডাবল শিফট (মর্নিং ও ডে শিফট) চালু রাখার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
৪. সমন্বিত পরিকল্পনা: শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন, যাতে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা একটি সুসংহত নিয়মের আওতায় চলতে পারে।
সব মিলিয়ে, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার এই উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে একটি যুগোপযোগী ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। যদিও এর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব। যদি এই সিদ্ধান্তটি সফলভাবে কার্যকর করা যায়, তবে এটি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি নীরব বিপ্লব ঘটাবে এবং আমাদের আগামী প্রজন্ম একটি গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
তথ্যের উৎস:
- শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
- মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)-এর বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন।
- প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার, সমকালসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন।