বাংলাদেশ সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলোর গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং উদযাপনের পরিধি দেখে মূলত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে: ‘ক’, ‘খ’, ও ‘গ’ (বা অন্যান্য) শ্রেণি। এই শ্রেণিবিভাগ দিয়ে বোঝা যায় কোন দিবসে কতটা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, সরকারি অংশগ্রহণ এবং জনসাধারণের সম্পৃক্ততা থাকবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে এই নিয়মগুলো জানানো হয়।
১. ‘ক’ শ্রেণির দিবস: সর্বোচ্চ জাতীয় মর্যাদা ও ব্যাপক উদযাপন
- কী ধরনের দিবস: জাতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো। এগুলো দেশের জন্য অত্যন্ত গৌরব ও স্মরণীয় দিন।
- কী কী হয়:
- সারাদেশে সরকারি ছুটি: সব অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে।
- জাতীয় পতাকা উত্তোলন বাধ্যতামূলক: সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ভবনে পতাকা ওড়ানো হয়।
- রাষ্ট্রীয় বাণী: রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বিশেষ বাণী দেন, যা সব গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।
- বিশেষ টিভি-রেডিও অনুষ্ঠান: টেলিভিশন ও রেডিওতে দিবসের তাৎপর্য নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান হয়।
- আলোচনা ও সভা: সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আলোচনা সভা, সেমিনার, দোয়া মাহফিল ইত্যাদি আয়োজিত হয়।
- দেশব্যাপী আয়োজন: জাতীয় পর্যায়ে বড় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও নানা কর্মসূচি পালিত হয়।
- গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ (২০২৫ সাল অনুযায়ী):
- ২৬ মার্চ: মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস (স্বাধীনতা ঘোষণা দিবস)
- ১৬ ডিসেম্বর: মহান বিজয় দিবস (মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়)
- ২১ ফেব্রুয়ারি: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (শহীদ দিবস) – ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে (ইউনেস্কো স্বীকৃত)
- ৫ আগস্ট: জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস (২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের স্মরণে, ২০২৫ থেকে ‘ক’ শ্রেণি)
২. ‘খ’ শ্রেণির দিবস: জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ, তবে সীমিত আনুষ্ঠানিকতা
- কী ধরনের দিবস: জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় দিন, তবে ‘ক’ শ্রেণির মতো ব্যাপক রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা বা ছুটি থাকে না। ভাবগাম্ভীর্যের সাথে স্মরণ করা হয়।
- কী কী হয়:
- ছুটি নেই: সব অফিস-আদালত খোলা থাকে, স্বাভাবিক কাজকর্ম চলে।
- সীমিত কর্মসূচি: সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তর আলোচনা সভা, সেমিনার বা ছোট আকারের বিশেষ অনুষ্ঠান করতে পারে। সাধারণত অফিস সময়ের পরে বা ছুটির দিনে আয়োজন করা হয়।
- স্থানীয় উদ্যোগ: জেলা বা উপজেলা প্রশাসন নিজেদের মতো করে সীমিত কর্মসূচি পালন করতে পারে।
- পতাকা উত্তোলন: সাধারণত ‘ক’ শ্রেণির মতো সর্বত্র বাধ্যতামূলক পতাকা উত্তোলন থাকে না।
- গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ (২০২৫ সাল অনুযায়ী):
- ১৪ ডিসেম্বর: শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস (মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার শোক দিবস)
- ১৬ জুলাই: জুলাই শহীদ দিবস (২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ছাত্রের স্মরণে, ২০২৫ থেকে ‘খ’ শ্রেণি)
- ২৫ মার্চ: গণহত্যা দিবস (১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতের স্মরণে)
৩. ‘গ’ শ্রেণি বা অন্যান্য দিবস: ঐচ্ছিক বা সীমিত পালন
- কী ধরনের দিবস: সরকারি প্রজ্ঞাপনে ‘ক’ বা ‘খ’ শ্রেণির তালিকায় নেই এমন দিবস। এগুলো হয় গতানুগতিক, পুনরাবৃত্তিমূলক, বা বর্তমান প্রেক্ষাপটে তেমন জাতীয় গুরুত্ব বহন করে না বলে সরকার মনে করে। সরকারি সময় ও সম্পদ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে এগুলোর আনুষ্ঠানিক পালন নিরুৎসাহিত করা হয়।
- কী কী হয়:
- কোনো সরকারি বাধ্যবাধকতা নেই: সরকারি অফিসগুলোকে এসব দিবস পালনের সাথে যুক্ত না হতে বলা হয়।
- ছুটি বা আনুষ্ঠানিকতা নেই: সাধারণ ছুটি থাকে না, জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বাধ্যবাধকতা নেই।
- ঐচ্ছিক পালন: কোনো বিশেষ সংগঠন, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের উদ্যোগে সীমিত আকারে দিবসটি পালন করতে পারে (যেমন: সেমিনার, সচেতনতামূলক কার্যক্রম)।
- উদাহরণ:
- বিভিন্ন ‘সপ্তাহ’ বা ‘পক্ষ’ (যেমন: শিক্ষা সপ্তাহ, মৎস্য পক্ষ): সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অফিসের কাজে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে খুব সীমিত পরিসরে আয়োজন করতে পারে।
- প্রস্তাবিত কিন্তু বাতিল/অপসারিত দিবস: যেমন ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ (৮ আগস্ট) প্রাথমিকভাবে ঘোষিত হলেও পরে সরকার এটা পালন না করার সিদ্ধান্ত নেয় (২ জুলাই, ২০২৫)।
কেন এই শ্রেণিবিভাগ?
- গুরুত্ব অনুযায়ী মর্যাদা: সব দিবস সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। শ্রেণিবিভাগের মাধ্যমে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিবসগুলো (‘ক’ শ্রেণি) সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান পায়।
- সরকারি সম্পদের সদ্ব্যবহার: সব দিবসে ব্যাপক উদযাপনে প্রচুর সময়, অর্থ ও সম্পদ লাগে। শ্রেণিবিভাগ করে সরকার শুধুমাত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিবসেই সম্পদ বিনিয়োগ করে।
- সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা: কোন দিবসে কী ধরনের কর্মসূচি হবে, কতটা সরকারি সম্পৃক্ততা থাকবে তা আগে থেকে জানা যায়, যা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সহজ করে।
সর্বোপরি: এই শ্রেণিবিভাগ বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি সরকারি কার্যক্রমকে সুসংগঠিত ও দক্ষ রাখার একটি কৌশল। ‘ক’ শ্রেণির দিবসগুলো জাতির চেতনার ধারক হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মান পায়, ‘খ’ শ্রেণির দিবসগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্মরণ হিসেবে পালিত হয়, আর অন্যান্য দিবসগুলো ঐচ্ছিকভাবে বা সীমিত আকারে স্মরণ করা হয়।