পর্ব ১২: শিক্ষার স্তম্ভ: শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নিবিড় সম্পর্ক
“শিক্ষার সহজ পাঠ” সিরিজের এই পর্যন্ত আমরা শিক্ষার মূল লক্ষ্য, জীবন দক্ষতা এবং মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে যিনি থাকেন—সেই শিক্ষক এবং তাঁর সঙ্গে শিক্ষার্থীর সম্পর্কটি কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব।
প্রকৃতপক্ষে, এই সম্পর্কটিই হলো শিক্ষার সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি। একটি সুন্দর ও কার্যকর সম্পর্ক শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জন, চরিত্র গঠন এবং ভবিষ্যতের সাফল্য—সবকিছুকেই প্রভাবিত করে।
শিক্ষক কেন পথপ্রদর্শক?
শিক্ষককে সাধারণত জ্ঞানের দাতা বা ‘Teacher’ বলা হয়। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে তাঁর ভূমিকা আরও ব্যাপক। তিনি এখন মূলত একজন সহায়ক (Facilitator), পথপ্রদর্শক (Guide), এবং সর্বোপরি একজন মেন্টর (Mentor)।
- জ্ঞান বিতরণের বাইরে: শিক্ষক শুধু পাঠ্যবইয়ের তথ্য মুখস্থ করান না। তিনি শেখান কীভাবে চিন্তা করতে হয়, কীভাবে প্রশ্ন করতে হয় এবং কীভাবে অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে হয়।
- চরিত্রের নির্মাতা: পরিবার যেমন শিশুর প্রথম শিক্ষালয়, তেমনি শিক্ষক হলেন তার দ্বিতীয় অভিভাবক। শিক্ষকের আদর্শ, ধৈর্য, সততা এবং ভালোবাসা শিক্ষার্থীর নৈতিক ভিত্তি গঠনে সাহায্য করে।
- নিরাপদ পরিবেশ তৈরি: একজন ভালো শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে এমন একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা ভয় বা সংকোচ ছাড়াই তাদের দুর্বলতা প্রকাশ করতে এবং যেকোনো প্রশ্ন করতে পারে।
শিক্ষার্থীর ভূমিকা: কেবল গ্রহীতা নয়
শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান গ্রহণ করাই শিক্ষার্থীর একমাত্র কাজ নয়। শিক্ষার প্রক্রিয়াটিকে সফল করতে শিক্ষার্থীরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়:
- শ্রদ্ধা ও সৌজন্য: শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁর নির্দেশনা ও পরামর্শের প্রতি মনোযোগ দেওয়া শিক্ষার প্রথম ধাপ। তবে এই শ্রদ্ধা যেন ভয় বা আড়ষ্টতার জন্ম না দেয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
- কৌতূহল ও প্রশ্ন: শেখার আসল চাবিকাঠি হলো কৌতূহল। কোনো বিষয় না বুঝে চুপ করে না থেকে প্রশ্ন করার সাহস তৈরি করতে হবে। একজন ভালো শিক্ষার্থী কেবল উত্তর খোঁজে না, সে সঠিক প্রশ্নটি করতে শেখে।
- দায়িত্বশীলতা: নিজের বাড়ির কাজ সময়মতো সম্পন্ন করা, ক্লাসের নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলা এবং সহপাঠীদের সাথে মিলেমিশে কাজ করার দায়িত্ব শিক্ষার্থীর।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত
আধুনিক ও কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থায় এই সম্পর্কটি পারস্পরিক আস্থা, সম্মান ও ভালোবাসার ভিত্তিতে গড়ে তোলা উচিত:
১. আস্থার সেতু বন্ধন (Bridge of Trust)
শিক্ষার্থীকে জানতে হবে যে, সে শিক্ষকের কাছে যেকোনো সমস্যা, তা সে পড়াশোনা সম্পর্কিত হোক বা ব্যক্তিগত, তা নিয়ে আলোচনা করতে পারে। অন্যদিকে, শিক্ষককেও শিক্ষার্থীর গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।
২. বন্ধুত্বের সীমানা (The Boundary of Friendship)
শিক্ষক শিক্ষার্থীর কাছে বন্ধুর মতো হতে পারেন, তবে সম্পর্কের মধ্যে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট গাম্ভীর্য ও সম্মানের সীমারেখা থাকা প্রয়োজন। বন্ধুত্বের অর্থ হলো—সাহায্য ও সহানুভূতির হাত বাড়ানো, কিন্তু এর মাধ্যমে শিক্ষাদানের গুরুত্ব যেন কমে না যায়।
৩. ব্যক্তিগত মনোযোগ (Individual Attention)
প্রতিটি শিক্ষার্থী আলাদা। তাদের শেখার গতি, দুর্বলতা ও আগ্রহ ভিন্ন। একজন শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত প্রয়োজনগুলো বোঝেন এবং সেই অনুযায়ী দিকনির্দেশনা দেন, তখন তাদের সম্পর্ক নিবিড় হয় এবং শিক্ষা ফলপ্রসূ হয়।
৪. ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া (Constructive Feedback)
শিক্ষকের উচিত শুধু ভুল ধরিয়ে দেওয়া নয়, বরং গঠনমূলক মন্তব্য বা (Constructive Feedback) দেওয়া। শিক্ষার্থীর প্রচেষ্টা এবং উন্নতির জন্য তাকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এতে শিক্ষার্থী উৎসাহিত হয় এবং ভুল থেকে শেখার সুযোগ পায়।
