প্রারম্ভিকা
নির্বাচন যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রাণ। এর মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে এবং শাসনব্যবস্থায় নিজেদের মতামত প্রতিফলিত করে। কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থা যদি জনগণের মতামতের সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়, তবে গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরণের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ ও ‘আনুপাতিক’ প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা। বর্তমান নিবন্ধে, আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার উদাহরণ এবং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার কার্যকারিতা, সুবিধা-অসুবিধা এবং প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা তুলে ধরব, যা ‘খোলবই’ প্লাটফর্মের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী হবে।
নির্বাচনী ব্যবস্থা: একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
১. সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব (Majoritarian Representation): এই ব্যবস্থায় একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন মাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পান, তিনিই জয়ী হন, যদিও তিনি মোট ভোটের অর্ধেকের কম পান। এই ব্যবস্থাকে ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ (First-Past-the-Post বা FPTP) বলা হয়। বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, ভারত, কানাডা প্রভৃতি দেশে এই ব্যবস্থা প্রচলিত।
২. আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation বা PR): এই ব্যবস্থায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল প্রাপ্ত ভোটের হারের অনুপাতে আইনসভায় আসন লাভ করে। অর্থাৎ, কোনো দল যদি সারাদেশে ৪০% ভোট পায়, তবে তারা আইনসভার প্রায় ৪০% আসন পাবে। জার্মানি, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ বিশ্বের অনেক দেশে এই ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বা মিশ্র রূপে চালু আছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যবস্থার সংকট ও বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা
- আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে যে যুক্তিগুলো তুলে ধরা হয়েছে, তা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রচলিত। এর কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যা রয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
- ভোটের অপচয় ও প্রতিনিধিত্বের সংকট: FPTP ব্যবস্থায় বিজয়ী প্রার্থী ছাড়া বাকি সব প্রার্থীর ভোট কার্যত কোনো কাজে আসে না। একটি আসনে যদি কোনো প্রার্থী ৩০% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন, বাকি ৭০% ভোট পেয়ে যারা হেরেছেন, তাদের মতামতের কোনো প্রতিফলন আইনসভায় ঘটে না। এর ফলে বিশাল সংখ্যক ভোটারের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হয় এবং সংসদে প্রকৃত জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। যেমন, কোনো দল সারাদেশে ৩৫% ভোট পেয়েও সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হতে পারে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে।
- রাজনৈতিক সংঘাত ও প্রতিহিংসা: ‘উইনার-টেক-অল’ বা বিজয়ীই সব পাবে—এই নীতির কারণে নির্বাচনে জয়-পরাজয় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। পরাজিত দলকে প্রায়শই ক্ষমতার বৃত্ত থেকে সম্পূর্ণ ছিটকে পড়তে হয়, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম প্রতিহিংসা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়। বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার বৈরী সম্পর্ক এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত во многом এই ব্যবস্থারই ফল।
- ছোট দলের বিলুপ্তি ও দ্বি-দলীয় আধিপত্য: এই ব্যবস্থায় ছোট বা নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে নির্বাচনে জয়লাভ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গন মূলত দুটি বড় দলের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং নতুন নেতৃত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে ভোটারদের সামনে বিকল্প কমে যায় এবং রাজনীতিতে একটি অচলায়তন সৃষ্টি হয়।
- অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব: একজন প্রার্থীকে একটি নির্দিষ্ট এলাকার নির্বাচনে জয়ী হতে হয় বলে এই ব্যবস্থায় অর্থ ও স্থানীয় প্রভাব বিস্তারের গুরুত্ব অনেক বেশি। এটি দুর্নীতি এবং নির্বাচনী সহিংসতাকে উৎসাহিত করে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব: একটি বিকল্প মডেল
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা (PR) উপরের সমস্যাগুলোর একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।
বিশ্বের উদাহরণ:
- জার্মানি: এখানে একটি মিশ্র ব্যবস্থা (Mixed-Member Proportional বা MMP) প্রচলিত। ভোটাররা দুটি ভোট দেন—একটি সরাসরি প্রার্থীকে (constituency vote) এবং অন্যটি রাজনৈতিক দলকে (party-list vote)। এর ফলে একদিকে যেমন এলাকার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়, তেমনি দলীয় ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদের আসন সংখ্যা নির্ধারিত হওয়ায় ছোট দলগুলোরও সংসদে আসার সুযোগ থাকে। এটি একটি স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনে সহায়তা করে।
- নিউজিল্যান্ড: ১৯৯৬ সালে দেশটি FPTP ব্যবস্থা থেকে জার্মানির মতো MMP ব্যবস্থায় উত্তরণ করে। এর ফলে দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বহুদলীয় জোট সরকার গঠিত হওয়ায় একক দলের একচ্ছত্র আধিপত্য কমেছে এবং রাজনীতিতে সহনশীলতা ও সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
- দক্ষিণ আফ্রিকা: বর্ণবাদ-পরবর্তী যুগে একটি বিভক্ত সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশুদ্ধ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে প্রতিটি ভোটই মূল্যবান হয় এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোরও সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তৈরি হয়, যা জাতীয় সংহতির জন্য অপরিহার্য ছিল।
বাংলাদেশের জন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রাসঙ্গিকতা:
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সম্ভাব্য সুবিধাসমূহ:
- স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা: এই ব্যবস্থায় কোনো একটি দলের পক্ষে এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে জোট সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে সহায়ক।
- সকল মতের প্রতিফলন: দলগুলো তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন পাওয়ায় সংসদে দেশের সকল প্রধান মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটে। এমনকি ১০-১৫% ভোট পাওয়া দলও সংসদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন পেতে পারে। এতে জনগণ নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করে না এবং সরকারের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি পায়।
- দুর্নীতি ও সহিংসতার হ্রাস: যেহেতু নির্বাচনটি মূলত দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে হয় এবং আসন বন্টন সারাদেশে প্রাপ্ত ভোটের ওপর নির্ভর করে, তাই স্থানীয় পর্যায়ে প্রার্থী কেন্দ্রিক অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব বহুলাংশে কমে আসবে। দলগুলো তখন আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে জনগণের কাছে ভোট চাইতে উৎসাহিত হবে।
- যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ: এই ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের তালিকার জন্য সারা দেশ থেকে যোগ্য, সৎ এবং দক্ষ ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিতে পারবে। এতে সংসদে মেধাবী ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের আসার সুযোগ বাড়বে, যা আইন প্রণয়নের মান উন্নত করবে।
চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা নিয়ে কিছু সমালোচনাও রয়েছে। যেমন, এতে অনেক সময় কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ‘ঝুলন্ত সংসদ’ (Hung Parliament) তৈরি হতে পারে এবং জোট সরকার গঠনে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দিতে পারে। সমালোচকরা আরও বলেন যে, এতে ভোটারদের সাথে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির সরাসরি সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে।
তবে এই সমস্যাগুলো সমাধানেরও পথ রয়েছে। জার্মানির মতো মিশ্র ব্যবস্থা (MMP) গ্রহণ করলে এলাকার প্রতিনিধিত্ব এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মধ্যে একটি ভারসাম্য আনা সম্ভব। এছাড়া, সংসদে আসন পাওয়ার জন্য ন্যূনতম ভোটের হার (e.g., ৩% বা ৫%) নির্ধারণ করে দিলে অতি ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক দলের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
উপসংহার: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট যে, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার এখন সময়ের দাবি। সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ্ধতির ‘বিজয়ীই সব পাবে’ নীতির পরিবর্তে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ‘সকল ভোটের মূল্য আছে’ নীতিটি গ্রহণ করা হলে তা দেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অচলায়তন ভাঙতে সহায়ক হতে পারে। এই ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও দায়িত্বশীল করে তুলবে, প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান ঘটাবে এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের জন্য বিষয়টি নিয়ে আরও গভীর আলোচনা ও বিতর্ক আয়োজন করা যেতে পারে। কারণ, একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার গণতান্ত্রিক কাঠামোর দৃঢ়তার ওপর, আর সেই দৃঢ়তার অন্যতম ভিত্তি হলো একটি সুষ্ঠু ও প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা।