আমাদের সন্তানের কাঁধে বইয়ের অসহনীয় বোঝা: একটি নীরব যন্ত্রণার গল্প

প্রতিদিন সকালে শহরের ব্যস্ত রাস্তার এক কোণে, ছোট্ট মেয়ে রিয়ার হাত ধরে স্কুলের গেটের দিকে হাঁটছেন তার বাবা আলমগীর। রিয়ার কাঁধে একটি স্কুলব্যাগ, যার ওজন প্রায় ২০ কেজি। আলমগীরের হাতে আরেকটি ব্যাগ—রিয়ার জলের বোতল, টিফিন বক্স আর কিছু খাতা-পেন্সিল। তিনি নিজেই হাঁপিয়ে উঠছেন, কিন্তু মনে মনে ভাবছেন, “আমার আট বছরের মেয়েটা এই বোঝা কীভাবে বইছে? এটা কি আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে করছি, নাকি অজান্তে অত্যাচার?”

রিয়ার গল্প: একটি শিশুর নীরব কষ্ট

রিয়া তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার স্কুলের রুটিনে প্রতিদিন ছয় পিরিয়ড ক্লাস। প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা বই, খাতা, আর গাইডবুক। ব্যাগে থাকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সমাজ, ধর্ম—সব মিলিয়ে প্রায় ১০টি বই। এ ছাড়া ড্রয়িং খাতা, জ্যামিতি বক্স, আর দুটো পানির বোতল। রিয়ার শরীরের ওজন ২৫ কেজি, আর তার ব্যাগের ওজন তার শরীরের ওজনের প্রায় ৮০%। স্কুলের চারতলার ক্লাসরুমে উঠতে গিয়ে রিয়া প্রতিদিন হাঁপায়। গত সপ্তাহে সে মাকে বলেছিল, “মা, আমার পিঠে ব্যথা করে। আমি আর ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি উঠতে চাই না।”

আলমগীর একদিন স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে দেখলেন, রিয়ার মতো আরো অনেক শিশু ঝুঁকে পড়া কাঁধ আর ক্লান্ত মুখ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। একটি ছেলে, আরিফ, তার ভারী ব্যাগ নিয়ে সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। তার বইগুলো ছড়িয়ে পড়ল, আর সে কেঁদে ফেলল। আলমগীরের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। তিনি ভাবলেন, “এটা কি আমাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা, নাকি শাস্তি?”

একটি মায়ের আক্ষেপ: সায়মার গল্প

সায়মা, একজন মধ্যবিত্ত গৃহিণী, তার ছেলে তানভীরের জন্য প্রতিদিন সকালে ব্যাগ গোছান। তানভীর পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। গত মাসে তানভীর বাড়ি ফিরে বলল, “মা, আমার ঘাড় ব্যথা করে। আমি আর স্কুলে যাব না।” সায়মা প্রথমে ভেবেছিলেন, এটা হয়তো ছেলের আলসেমি। কিন্তু একদিন তিনি নিজে তানভীরের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দেখলেন, তিনি নিজেই দুই মিনিটের বেশি বইতে পারছেন না। তিনি ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার জানালেন, তানভীরের পিঠের পেশিতে অস্বাভাবিক টান পড়ছে। দীর্ঘমেয়াদে এটা তার মেরুদণ্ডের ক্ষতি করতে পারে। সায়মা ফিরে এসে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমি তো ভেবেছিলাম, এতগুলো বই পড়লে আমার ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু এই বইয়ের ভারই তো তাকে অসুস্থ করে তুলছে!”

শিক্ষকের দৃষ্টিকোণ: শাহানার উপলব্ধি

শাহানা বেগম একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তিনি লক্ষ্য করেছেন, তার ক্লাসের অনেক শিশু ক্লাসে এসে ক্লান্ত থাকে। কেউ কেউ ঘাড়ে হাত দিয়ে বসে থাকে, কেউ ঝিমিয়ে পড়ে। একদিন তিনি একটি ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ব্যাগে কী কী আছে?” ছাত্রীটি তার ব্যাগ খুলে দেখাল—১২টি বই, ৮টি খাতা, আর অন্যান্য জিনিস। শাহানা অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, “আমরা কি শিশুদের শেখানোর নামে তাদের শরীর নষ্ট করছি?” সেদিন থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি তার ক্লাসে শুধু একটি বই নিয়ে আসবেন আর বোর্ডে নোট লিখে দেবেন। শিশুদের বই আনতে হবে না। তার এই ছোট্ট উদ্যোগে তার ক্লাসের শিশুদের মুখে হাসি ফিরে এল।

বিশেষজ্ঞদের চোখে ভয়ঙ্কর সত্য

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরের ওজনের ১০-১৫% এর বেশি ওজনের ব্যাগ বহন করা উচিত নয়। অথচ আমাদের শিশুরা ৫০-৮০% ওজন বহন করছে। এর ফলে:

  • মেরুদণ্ডের ক্ষতি: স্কলিওসিস বা কাইফোসিসের মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ঢাকার একটি হাসপাতালে গত বছর ২০০ শিশুর মধ্যে ৩৫% শিশুর মেরুদণ্ডে অস্বাভাবিক বক্রতা ধরা পড়েছে।
  • পেশির ব্যথা: দীর্ঘমেয়াদী পেশির টান শিশুদের বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।
  • মানসিক চাপ: ভারী ব্যাগের কারণে শিশুরা স্কুলে যেতে ভয় পায়। এটি তাদের পড়াশোনার প্রতি অনীহা তৈরি করে।

একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বললেন, “আমরা শিশুদের শিক্ষিত করতে গিয়ে তাদের শৈশব কেড়ে নিচ্ছি। এটা শিক্ষা নয়, এটা এক ধরনের নির্যাতন।”

সমাধানের পথ: আমরা কী করতে পারি?

এই সমস্যার সমাধান আমাদের হাতেই। আমরা সবাই মিলে ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে পারি।

অভিভাবকদের জন্য:

  • ব্যাগের ওজন চেক করুন: রিয়ার বাবা আলমগীর এখন প্রতিদিন রুটিন দেখে অপ্রয়োজনীয় বই ব্যাগ থেকে বের করে দেন। ফলে রিয়ার ব্যাগের ওজন ২০ কেজি থেকে ১০ কেজিতে নেমে এসেছে।
  • স্কুলের সঙ্গে কথা বলুন: সায়মা এখন অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে মিলে স্কুলে একটি পিটিশন জমা দিয়েছেন, যাতে লকারের ব্যবস্থা করা হয়।
  • শিশুর কথা শুনুন: আপনার সন্তান যদি ব্যথার কথা বলে, তাকে গুরুত্ব দিন। তানভীরের মা সায়মা এখন প্রতিদিন ছেলের সঙ্গে ব্যাগের ওজন নিয়ে আলোচনা করেন।

শিক্ষকদের জন্য:

  • একটি বইয়ের ক্লাসরুম: শাহানা বেগমের মতো শিক্ষকরা যদি ক্লাসে একটি বই নিয়ে আসেন, তাহলে শিশুদের বোঝা অনেক কমবে। একটি স্কুলে এই পদ্ধতি চালু করার পর শিশুদের উপস্থিতি ১০% বেড়েছে।
  • ডিজিটাল সমাধান: গণিতের শিক্ষক রহিম স্যার এখন তার ক্লাসে প্রজেক্টরে পিডিএফ বই দেখান। শিশুরা আর বই বহন করে না, তবু পড়াশোনা অব্যাহত থাকে।

স্কুল কর্তৃপক্ষের জন্য:

  • লকার সিস্টেম: ঢাকার একটি স্কুলে লকার চালু করার পর শিশুদের ব্যাগের ওজন ৬০% কমেছে। শিশুরা এখন শুধু দরকারি খাতা আর পেন্সিল নিয়ে আসে।
  • শেয়ারিং সিস্টেম: একটি বেঞ্চে দুজন শিক্ষার্থী একটি বই শেয়ার করলে ব্যাগের ওজন অর্ধেক হয়ে যায়।
  • স্মার্ট রুটিন: একটি স্কুল প্রতিদিন তিনটি বিষয়ের ক্লাস রাখে, ফলে শিশুদের তিনটি বইয়ের বেশি বহন করতে হয় না।

শেষ কথা: আমাদের সন্তানের হাসি ফিরিয়ে দিই

রিয়া, তানভীর, আরিফ—এরা আমাদের সন্তান। তাদের কাঁধে আমরা ভারী বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি, অথচ তাদের হাসি আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমরা কি চাই, আমাদের শিশুরা স্কুলকে ভয় পাক? নাকি চাই, তারা হাসিমুখে স্কুলে যাক, আনন্দে পড়াশোনা করুক?

প্রিয় অভিভাবক ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ, এই পরিবর্তন আমরা একা করতে পারব না। আলমগীর, সায়মা, শাহানা বেগম—এদের মতো একজন একজন করে এগিয়ে আসুন। আপনার ছোট্ট পদক্ষেপই পারে আমাদের শিশুদের শৈশবকে ফিরিয়ে দিতে। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই নীরব অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলি। আমাদের সন্তানদের কাঁধ থেকে বইয়ের বোঝা নামিয়ে তাদের হাতে তুলে দিই একটি সুন্দর, সুস্থ ভবিষ্যৎ।

(এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিন। আপনার একটি শেয়ার পারে একটি শিশুর শৈশব বাঁচাতে।)

About Admin

Check Also

২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী বন্ধুরা, শেষ মুহূর্তের সাফল্যের গল্পটা লিখবে তোমরা!

প্রিয় এইচএসসি পরীক্ষার্থী বন্ধুরা, আর মাত্র ক’টা দিন! তোমাদের দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি আর স্বপ্নের পালে বাতাস …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Skip to toolbar