বিষয়: উত্তরাধিকার, এজমালি সম্পত্তি এবং পুরনো উপহার রিটার্নে দেখানোর জটিলতা
আয়কর রিটার্ন নিয়ে পাঠকদের করা কিছু বাস্তবসম্মত ও জটিল প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আজকের এই বিশেষ পর্ব। এখানে অভিজ্ঞ আয়কর পেশাজীবীর (ITP) দৃষ্টিকোণ থেকে আয়কর আইন, ২০২৩ এবং বাস্তবসম্মত সমাধানগুলো তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন ১: উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এজমালি (অবিভক্ত) সম্পত্তি, যা এখনো আমার নামে নামজারি (Mutation) হয়নি বা বি.এস. রেকর্ড সংশোধনের মামলা চলছে, তা কি রিটার্নে দেখানো বাধ্যতামূলক? কীভাবে দেখাব?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি দেখানো অবশ্যই বাধ্যতামূলক। এর কারণ ও সমাধান নিচে দেওয়া হলো:
১. আইনগত যুক্তি (মালিকানা বনাম নামজারি):
আপনাকে বুঝতে হবে, আয়কর বিভাগ আপনার “মালিকানা স্বত্ব” (Ownership) বিবেচনা করে, কেবল কাগজের “নামজারি” (Mutation) নয়। উত্তরাধিকার আইন (যেমন: মুসলিম ফারায়েজ) অনুযায়ী, আপনার পূর্বপুরুষের মৃত্যুর মুহূর্ত থেকেই আপনি আইনত ওই সম্পত্তির একজন অংশীদার বা মালিক। নামজারি হলো রাজস্ব (খাজনা) আদায়ের জন্য সরকারি রেকর্ডে নাম হালনাগাদ করা, এটি মালিকানা স্বত্ব তৈরি করে না।
২. ঝুঁকি (Risk):
আপনি আইনত মালিক হওয়া সত্ত্বেও যদি এই সম্পদ রিটার্নে না দেখান, তবে এটি আয়কর কর্তৃপক্ষের কাছে “সম্পদ গোপন” (Concealment of Asset) হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যা জরিমানা ও অডিটের কারণ হতে পারে।
৩. কীভাবে রিটার্নে দেখাবেন (বাস্তব সমাধান):
যেহেতু সম্পত্তিটি এজমালি এবং এখনো আপনার নামে নির্দিষ্টভাবে ভাগ বা নামজারি হয়নি, তাই আপনি এটি এভাবে দেখাবেন:
- সম্পদের বিবরণ: “উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এজমালি/অবিভক্ত জমির শেয়ার (যেমন: ১/৩ অংশ)”।
- অবস্থান: জমির মৌজা ও খতিয়ান নম্বর (পুরনো খতিয়ান যা আছে) উল্লেখ করুন।
- মূল্য: “শূন্য” দেখানো যাবে না। আপনাকে ওই পুরো এজমালি সম্পত্তির বর্তমান ন্যায্য বাজারমূল্য (Current Fair Market Value) বের করতে হবে এবং সেই মূল্যের বিপরীতে আপনার আইনগত যে অংশ (Share), সেই অংশের মূল্য দেখাতে হবে।
- উদাহরণ: একটি এজমালি জমির বর্তমান বাজারমূল্য ৯০ লক্ষ টাকা। আপনি তিন ভাইবোন হলে আপনার অংশ ১/৩ বা ৩০ লক্ষ টাকা। আপনি আপনার রিটার্নে ৩০ লক্ষ টাকার সম্পদ দেখাবেন।
- মন্তব্য: রিটার্নের মন্তব্য সেকশনে অবশ্যই উল্লেখ করবেন যে, “সম্পত্তিটি এজমালি, নামজারি ও ভাগ-বণ্টন প্রক্রিয়াধীন” বা “বি.এস. রেকর্ড সংশোধনের মামলা চলমান”।
প্রশ্ন ২: ২০-২৫ বছর আগে উপহার হিসেবে পাওয়া কোনো জিনিসের (যেমন: সোনা, আসবাবপত্র) তৎকালীন মূল্য আমার জানা নেই। এর মূল্য কীভাবে নির্ধারণ করব?
উত্তর: এটি একটি খুবই বাস্তবসম্মত প্রশ্ন। আয়কর বিভাগও জানে যে ২৫ বছর আগের সঠিক মূল্য বের করা কঠিন। এক্ষেত্রে “শূন্য” না দেখিয়ে আপনাকে একটি “সদিচ্ছাকৃত যৌক্তিক অনুমান” (Good Faith Reasonable Estimate) দেখাতে হবে।
- সোনার ক্ষেত্রে: এটি তুলনামূলক সহজ। আপনি যদি ১৯৯৮ সালে ১ ভরি সোনা উপহার পান, আপনি অনলাইনে খুব সহজেই ওই বছরের একটি আনুমানিক মূল্য (যেমন: ৫,০০০ টাকা) বের করতে পারবেন।
- জমি/ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে: এটি কঠিন। আপনি ওই সময়ের মৌজা রেট (Mouza Rate) বা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের রেট (যদি পাওয়া যায়) ব্যবহার করতে পারেন। যদি তা-ও সম্ভব না হয়, তবে একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য (Conservative but Reasonable) মূল্য ঘোষণা করুন।
গুরুত্বপূর্ণ নোট: কোনোভাবেই “শূন্য” (০) দেখানো যাবে না। ২৫ বছর আগে পাওয়া ১ ভরি সোনার মূল্য যদি আপনি ৫,০০০ টাকাও দেখান, তা ‘শূন্য’ দেখানোর চেয়ে আইনগতভাবে লক্ষ গুণ বেশি সঠিক।
প্রশ্ন ৩: যে সম্পদ পেতে আমার কোনো অর্থ খরচ হয়নি (Cost = 0), তার আর্থিক মূল্য দেখাতে হবে কেন?
উত্তর: এটাই আয়কর রিটার্নের সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তির জায়গা। উত্তরটি হলো: হ্যাঁ, মূল্য অবশ্যই দেখাতে হবে। এর পেছনে দুটি প্রধান কারণ রয়েছে— একটি আইনি, অন্যটি আপনার নিজের আর্থিক সুরক্ষা।
১. আইনি ধারণা (ক্রয়মূল্য বনাম সম্পদের মূল্য):
এটা সত্য যে আপনার “ক্রয়মূল্য” (Cost) শূন্য। কিন্তু আয়কর আইন আপনার কাছে “ক্রয়মূল্য” চায়নি; আইন আপনার কাছে সম্পদটির “মূল্য” (Value) জানতে চেয়েছে। প্রতিটি সম্পদেরই একটি মূল্য আছে, তা আপনি বিনামূল্যে পেলেও।
২. আপনার নিজের সুরক্ষা (মূলধনী লাভ বা Capital Gain):
ভবিষ্যতে ওই সম্পদ বিক্রি করার সময় বিশাল অংকের কর এড়ানোর জন্য এটি দেখানো জরুরি। আসুন একটি উদাহরণ দেখি:
- দৃশ্যকল্প-১ (আপনি মূল্য ‘শূন্য’ দেখিয়েছেন):
- আপনি ২৫ বছর আগে পাওয়া একটি জমি রিটার্নে ‘শূন্য’ মূল্যে দেখিয়েছেন।
- আজ আপনি জমিটি ৫০ লক্ষ টাকায় বিক্রি করলেন।
- আয়কর বিভাগের হিসাবে আপনার লাভ (Capital Gain) = (বিক্রয়মূল্য – প্রাপ্তিমূল্য) = (৫০,০০,০০০ – ০) = পুরো ৫০,০০,০০০ টাকা।
- আপনাকে এই পুরো ৫০ লক্ষ টাকার ওপরই (প্রযোজ্য হারে) কর দিতে হতে পারে।
- দৃশ্যকল্প-২ (আপনি যৌক্তিক মূল্য দেখিয়েছেন):
- আপনি ২৫ বছর আগের জমির আনুমানিক মূল্য ২,০০,০০০ টাকা দেখিয়েছিলেন।
- আজ আপনি জমিটি ৫০ লক্ষ টাকায় বিক্রি করলেন।
- আপনার লাভ (Capital Gain) = (৫০,০০,০০০ – ২,০০,০০০) = ৪৮,০০,০০০ টাকা।
- এক্ষেত্রে আপনি শুধু ৪৮ লক্ষ টাকার ওপর কর দেবেন, পুরো ৫০ লক্ষের ওপর নয়।
সমাধান (IT-10BB): আপনি যে ২ লক্ষ টাকা খরচ না করেই পেলেন, সেই টাকা রিটার্নের IT-10BB (সমন্বয়) ফর্মে “করমুক্ত প্রাপ্তি” (Tax-Free Receipt) বা “উপহার/উত্তরাধিকার” হিসেবে দেখিয়ে খুব সহজেই হিসাব মিলিয়ে ফেলা যায়।
প্রশ্ন ৪: এই নিয়মগুলোর আইনি ভিত্তি কী?
উত্তর: এই সকল ব্যাখ্যার মূল ভিত্তি হলো:
১. আয়কর আইন, ২০২৩: এই আইনের অধীনে সম্পদ ও দায় বিবরণী (IT-10B) এবং জীবনযাত্রার ব্যয় ও সম্পদ-দায়ের সমন্বয় (IT-10BB) দাখিল সংক্রান্ত ধারা।
২. ষষ্ঠ তফসিল (Sixth Schedule), আয়কর আইন, ২০২৩: যেখানে উপহার ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তিকে “করমুক্ত প্রাপ্তি” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে (তবে তা অবশ্যই রিটার্নে প্রদর্শনসাপেক্ষে)।
৩. জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR)-এর নির্দেশিকা: যা রিটার্নের স্বচ্ছতা এবং ন্যায্য বাজারমূল্য (Fair Market Value) প্রদর্শনের ওপর গুরুত্বারোপ করে।
####################৳#৳৳
সম্পূর্ণ লেখাটি ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করি এই উত্তরগুলো আপনার বিভ্রান্তি দূর করতে এবং একটি নির্ভুল রিটার্ন দাখিল করতে সাহায্য করব।
আয়কর রিটার্ন তৈরি যেকোনো জটিল বিষয়ে নির্ভুল, পেশাদার এবং সাশ্রয়ী মূল্যে আমার সহায়তা প্রয়োজন হলে, যেকোনো সময় আমার নিচের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মেসেজ দিতে পারেন।
আমি নিজে আপনার রিটার্নটি পর্যালোচনা ও দাখিল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
সবার জন্য শুভকামনা রইলো।
ধন্যবাদান্তে, মুহম্মদ জিয়াউর রহমান ইনকাম ট্যাক্স প্র্যাকটিশনার (ITP) এনবিআর (NBR) অনুমোদিত WhatsApp: 01710-935-356 TaxCraf Consulting
