ড. আকবর আলি খান। একটি নাম, একটি আদর্শ। এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি জীবনে কখনোই মেরুদণ্ড বাঁকাননি, শুধু জায়নামাজ ছাড়া। এই ঋজুতার জন্য তাঁকে কম মূল্য দিতে হয়নি, তবে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি সেই আত্মসম্মানবোধের আনন্দে আপ্লুত ছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা, সততা, উন্নত মানসিকতা এবং অকুতোভয় সংগ্রামী চেতনা অনেককে অনুপ্রাণিত করে, ঠিক যেমনটি করেছে এই লেখার লেখককে।
ড. আকবর আলি খান তাঁর কর্মজীবনে ছিলেন আপসহীন। একজন সিনিয়রকে শ্রদ্ধা করা এবং তোষামোদ করা এক জিনিস নয়—এই নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। পীরের মতো শ্রদ্ধা করলেও, তিনি কখনো তেল দেননি বা হাত কচলাইনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা থাকাকালীন নিজের নীতি অনুযায়ী কাজ করতে না পেরে তিনি পদত্যাগ করেন। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যে দৃঢ় মেরুদণ্ড দরকার, তা তৈরি হয় সত্যনিষ্ঠ জ্ঞান, সততা, অটল কর্তব্যবোধ, দক্ষতা এবং গভীর দেশপ্রেম থেকে। তাঁর মধ্যে এই সব গুণ ছিল মাত্রাতিরিক্ত।
হিমালয়ের মতো অটল মনোবল
২০০৮ সালে মেরুদণ্ডের অপারেশনের পর যখন তাঁর হাত-পা প্রায় অচল হয়ে যায়, তখনো তিনি থেমে থাকেননি। ফিজিওথেরাপি নিয়ে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর টাইপ করা শুরু করেন। ২০১৫ সালের পর যখন টাইপ করার ক্ষমতাও হারালেন, তখন একজন কম্পিউটার অপারেটরের সাহায্যে তিনি তাঁর পাণ্ডুলিপি তৈরি করতেন। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি কঠিনতম আঘাতের শিকার হয়েছেন। একমাত্র কন্যার অকাল মৃত্যু, এরপর জীবনসঙ্গিনীর প্রয়াণ—সবকিছুই তিনি নীরবে সহ্য করেছেন। পাষাণের মতো অবিচল থেকেছেন। কিন্তু এসব বিপর্যয় তাঁর মন ভাঙতে পারেনি, বরং তাঁর মেধার নির্যাস বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই অসীম মনোবলই তাঁকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সৃষ্টিশীল রেখেছে।
লেখকের জীবন ও দর্শন
ড. আকবর আলি খানের লেখালেখি ছিল তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ের এক নতুন দিক। তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবনের শেষ দিনগুলো উপভোগ করার সেরা উপায় হলো জ্ঞানচর্চা এবং তা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। তাঁর বইগুলো এর প্রমাণ। ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ থেকে ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’—প্রতিটি লেখায় তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ফুটে ওঠে।
তাঁর আত্মজীবনী লেখার আগ্রহ নিয়েও একটি মজার তথ্য তিনি দিয়েছিলেন। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে: “History is written by the victor; autobiography is written by the vanquished.” অর্থাৎ, ইতিহাস লেখে বিজয়ী, আর আত্মজীবনী লেখে পরাজিত। এই কথা বলার মধ্য দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, সত্যনিষ্ঠ আত্মজীবনী লেখা কতটা কঠিন।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। তিনি লিখেছিলেন যে তাঁর আত্মজীবনী দ্বিতীয় খণ্ড মৃত্যুর পর প্রকাশিত হবে, এবং তিনি সেটির নির্দেশনাও দিয়ে যাবেন। আমরা এখনো জানি না তিনি তা লিখে যেতে পেরেছিলেন কিনা। কিন্তু তাঁর অসমাপ্ত জীবনের গল্প আমাদের জন্য এক অমোঘ অনুপ্রেরণা।
৯ সেপ্টেম্বর এই জ্ঞানতাপস আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর সততা, প্রজ্ঞা এবং অটল ব্যক্তিত্ব চিরকাল আমাদের জন্য এক আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।
আল্লাহ্ রব্বুল আলামিন তাঁকে মাফ করে দিন এবং জান্নাতুল ফেরদউসে দাখিল করুন। আমিন।