একটি কলেজ, তিনটি ক্লাসরুম – নেতৃত্বের ভিন্নস্বাদ
চট্টগ্রাম ইপিজেড-এর প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে বেপজা পাবলিক স্কুল ও কলেজ। কল্পনা করুন দ্বাদশ শ্রেণির একটি সকালের তিনটি ভিন্ন বিভাগের দৃশ্যপট – যেন নেতৃত্বের তিনটি ভিন্ন রঙে রাঙানো ক্যানভাস।
দৃশ্যপট এক: বিজ্ঞান বিভাগের উচ্চতর গণিত ক্লাস
বোর্ডে জটিল একটি ক্যালকুলাসের সমাধান করতে গিয়ে শেষ ধাপে সামান্য ভুল করে ফেলল একজন ছাত্র। শিক্ষক তার দিকে তাকিয়ে তিরস্কারের সুরে বললেন, “এতবার করানোর পরেও এই সাধারণ ভুল করো! মনোযোগ থাকে কোথায়? তোমার ভবিষ্যৎ আমি দেখতে পাচ্ছি।” অপমান আর হতাশায় ছাত্রটির মুখ লাল হয়ে গেল। পুরো ক্লাসে এমন এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি হলো যে, বাকিদের মনে প্রশ্ন থাকলেও তা করার সাহসটুকু হারিয়ে গেল।
দৃশ্যপট দুই: মানবিক বিভাগের যুক্তিবিদ্যা ক্লাস
একটি বিতর্কের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা চলছে। একজন ছাত্র তার স্বপক্ষে একটি যুক্তি উপস্থাপন করল, যার মধ্যে সুস্পষ্ট যৌক্তিক হেত্বাভাস বা ফ্যালাসি (Logical Fallacy) ছিল। শিক্ষক বিষয়টি বুঝতে পারলেও ভাবলেন, ছাত্রটির ভুল ধরিয়ে দিলে সে হয়তো সবার সামনে লজ্জিত হবে বা মনে কষ্ট পাবে। তাই তিনি তার যুক্তির দুর্বলতা না দেখিয়ে শুধু বললেন, “খুব সাহসের সাথে বলেছ, চালিয়ে যাও!” ছাত্রটি সাময়িকভাবে উৎসাহিত হলো, কিন্তু যুক্তিবিদ্যার মূল ভিত্তি—শুদ্ধভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাই তার তৈরি হলো না।
দৃশ্যপট তিন: ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ক্লাস
শিক্ষার্থীরা একটি কাল্পনিক ব্যবসায়িক সমস্যা (Business Case Study) নিয়ে তাদের সমাধান উপস্থাপন করছে। তাদের উপস্থাপনায় কিছু কৌশলগত দুর্বলতা ছিল। শিক্ষক উপস্থাপনা শেষে দলটিকে সবার সামনে বললেন, “তোমাদের গবেষণা এবং একটি সমাধানের পথে আসার প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। তোমাদের মূল ধারণাটি চমৎকার, তবে চলো আমরা সবাই মিলে ভাবি এটিকে বাস্তবতার নিরিখে আরও কীভাবে কার্যকর করা যায়।” এরপর তিনি দুর্বল দিকগুলো নিয়ে এমনভাবে আলোচনা শুরু করলেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই তাদের ভুলগুলো বুঝতে পারল এবং সমাধানটিকে আরও উন্নত করতে উৎসাহিত হলো।
এই তিনটি দৃশ্যপট শুধু বেপজা কলেজের নয়, বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের প্রতিচ্ছবি। নেতৃত্ব শুধু শীর্ষে নয়; শ্রেণিকক্ষে, বাড়িতে, আড্ডায় – এর প্রভাব সর্বত্র। আসুন, এই তিন নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি বিশ্লেষণ করি।
নেতৃত্ব শুধু কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তার জন্য নয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে—শ্রেণিকক্ষে, বাড়িতে, এমনকি বন্ধুদের আড্ডাতেও—এর প্রভাব অকল্পনীয়। চলুন আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি, এই তিন ধরনের নেতৃত্ব কীভাবে আমাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের জগতকে প্রতিনিয়ত গড়ে তুলছে বা ভাঙছে।
১। বিষাক্ত নেতৃত্বের শৃঙ্খল – যেখানে মেধার অপমৃত্যু ঘটে
প্রথম দৃশ্যপটের উচ্চতর গণিত ক্লাসের শিক্ষক হলেন একজন ‘বিষাক্ত নেতা’ (The Toxic Leader)-এর প্রতিচ্ছবি। তার শাসনের মূল ভিত্তি হলো ভয়, নিয়ন্ত্রণ এবং নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব।
বাস্তবতার ক্যানভাসে: এই ধরনের নেতৃত্ব শুধু পরীক্ষার ফলাফলের উপর জোর দেয়, শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থার দিকে তাকায় না। ধরা যাক, একজন অভিভাবক তার সন্তানের রিপোর্ট কার্ড হাতে পেয়ে ৯৫ পাওয়া বিষয়গুলো না দেখে যে বিষয়ে ৮০ পেয়েছে, সেটি নিয়ে তুলকালাম শুরু করলেন। প্রতিবেশীর সন্তানের সাথে তুলনা করে বললেন, “ও পারলে তুমি পারো না কেন? তোমার পেছনে এত টাকা খরচ করে লাভ কী?”
এর সুদূরপ্রসারী ফল: এই ধরনের পরিবেশে শিক্ষার্থীরা শেখে ভয়ে, ভালোবাসায় নয়। তাদের কৌতূহল ও সৃজনশীলতা ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়। তারা ভুল করতে ভয় পায়, আর তাই নতুন কিছু চেষ্টাও করে না। পড়াশোনা তাদের কাছে জ্ঞান অর্জনের আনন্দ নয়, বরং একটি যন্ত্রণাদায়ক দায়িত্ব হয়ে ওঠে। এই শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে বহু সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীর মেধার অকালে অপমৃত্যু ঘটে। তারা শেখে শুধু নিজের কৃতিত্ব নিতে এবং অন্যের উপর দোষ চাপাতে।
২। তথাকথিত ‘ভালো’ নেতার মায়া – স্নেহের আড়ালে যে ক্ষতি
দ্বিতীয় দৃশ্যপটের যুক্তিবিদ্যা ক্লাসের শিক্ষক হলেন একজন ‘তথাকথিত ভালো নেতা’ (The “Nice” Leader)। তিনি জনপ্রিয় হতে চান, সম্মান অর্জন করতে নয়। সংঘাত ও অপ্রিয় সত্য এড়িয়ে চলাই তার মূল চালিকাশক্তি।
বাস্তবতার ক্যানভাসে: এই ধরনের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাছে ‘ফেভারিট’ হন কারণ তারা কঠিন কথা বলেন না। যুক্তিবিদ্যার ক্লাসে ভুল যুক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া বা সাহিত্যের ক্লাসে দুর্বল লেখাকে ভালো বলা—এর সবই এই নেতৃত্বের অংশ। একইভাবে, যে অভিভাবক সন্তানের সব আবদার পূরণ করেন এবং তার কোনো ভুল ধরিয়ে দেন না, তিনিও এই ভূমিকা পালন করেন। তারা ভাবেন, “আহা, ছোট মানুষ, কষ্ট পাবে!”
এর সুদূরপ্রসারী ফল: এই আপাতস্নেহের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ। শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জ নিতে শেখে না, ব্যর্থতা সামলাতে পারে না এবং গঠনমূলক সমালোচনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ বলে ধরে নেয়। তারা একটি আরামদায়ক বুদবুদের মধ্যে বড় হয়, কিন্তু বাস্তব পৃথিবীর কঠোর প্রতিযোগিতায় পা রাখতেই সেই বুদবুদটি ফেটে যায়। এই নেতৃত্ব তাৎক্ষণিক আরাম দিলেও আদতে তা শিক্ষার্থীদের দীর্ঘমেয়াদী বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেয়। এটি অনেকটা মিষ্টি বিষের মতো, যা তাৎক্ষণিকভাবে তৃপ্তি দিলেও ভেতরে ভেতরে ধ্বংস করে দেয়।
৩। প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের পরশ – যেখানে সম্ভাবনার চারাগাছ বেড়ে ওঠে
তৃতীয় দৃশ্যপটের ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ক্লাসের শিক্ষক হলেন একজন ‘প্রজ্ঞাবান ও দয়ালু নেতা’ (The Kind Leader)। সহানুভূতি, স্পষ্টতা এবং পারস্পরিক সম্মান হলো তার নেতৃত্বের মূল ভিত্তি।
বাস্তবতার ক্যানভাসে: তিনি হলেন সেই শিক্ষক, যিনি শিক্ষার্থীর ভুলকে সবার সামনে তুলে ধরে লজ্জা দেওয়ার পরিবর্তে সেটিকে একটি শেখার সুযোগ হিসেবে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। তিনি বোঝেন যে, উচ্চ মান নির্ধারণ করার অর্থ কঠোর হওয়া নয়, বরং সেই মানে পৌঁছানোর জন্য পথ দেখানো। তিনি সেই অভিভাবক, যিনি সন্তানের পরীক্ষায় খারাপ ফলের জন্য বকা না দিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলেন, “কী হয়েছে তাতে? জীবনটা তো আর একটা পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে না। চলো, পরেরবার আরও ভালো করে প্রস্তুতি নেওয়া যাবে।”
এর সুদূরপ্রসারী ফল: এই নেতৃত্বের ছায়াতলে শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। তারা ভুলকে ব্যর্থতা না ভেবে শেখার একটি ধাপ হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে এবং তারা শুধু ভালো শিক্ষার্থী নয়, একজন ভালো মানুষ হিসেবেও বিকশিত হয়। এই পরিবেশেই জন্ম নেয় ভবিষ্যতের প্রকৃত নেতা, বিজ্ঞানী, শিল্পী ও স্বপ্নদ্রষ্টা।
শেষ কথা: আমরা কোন পথের পথিক হব?
খোলা বই প্ল্যাটফর্মের সম্মানিত শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আমাদের সবারই আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে।
-
শিক্ষক হিসেবে আমরা কি ক্লাসে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করছি, নাকি বিশ্বাসের সেতু তৈরি করছি?
-
অভিভাবক হিসেবে আমরা কি সন্তানের উপর প্রত্যাশার পাহাড় চাপাচ্ছি, নাকি তাদের স্বপ্নের পথে সহযাত্রী হচ্ছি?
-
শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা কি একে অপরকে টেনে নামাচ্ছি, নাকি একসাথে হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছি?
প্রতিটি শিক্ষার্থী একটি সম্ভাবনাময় চারাগাছের মতো। বিষাক্ত নেতৃত্ব সেই চারাগাছকে পুড়িয়ে ফেলে। তথাকথিত ‘ভালো’ নেতৃত্ব তাকে আগাছার মধ্যে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখে। আর একজন প্রজ্ঞাবান ও দয়ালু নেতাই হলেন সেই যত্নশীল মালী, যিনি সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে সেই চারাগাছকে একটি সুবিশাল ও সুশোভিত বৃক্ষে পরিণত হতে সাহায্য করেন।
আসুন, আমরা সবাই মিলে আমাদের শিক্ষাঙ্গনকে এমন একটি বাগান হিসেবে গড়ে তুলি, যেখানে প্রতিটি চারাগাছ নির্ভয়ে, সম্মানের সাথে, তার পূর্ণ সম্ভাবনার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। আমাদের আজকের নেতৃত্বই গড়বে আগামীর বাংলাদেশ।