গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা দর্শন ও প্রচলিত আইনানুগ কাঠামোর আলোকে, অধ্যক্ষ পদটি কেবলমাত্র প্রশাসনিক কর্তৃত্বের প্রতীক নয়; বরং এটি একটি গভীর সামাজিক-রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসেবে অধ্যক্ষই জাতীয় শিক্ষার রূপকল্প বাস্তবায়নের প্রাণশক্তি। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন, জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ এবং অন্যান্য প্রযোজ্য বিধিবিধানের পরিপ্রেক্ষিতে একজন আদর্শ অধ্যক্ষের অপরিহার্য গুণাবলী ও পেশাদার কর্তব্যাবলী নিম্নরূপ:
১. প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব ও কৌশলগত দূরদর্শিতা (Institutional Leadership & Strategic Vision)
রূপকল্প প্রণয়ন ও নেতৃত্ব: অধ্যক্ষের প্রাথমিক দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি বাস্তবসম্মত, প্রাসঙ্গিক ও সুদূরপ্রসারী রূপকল্প (Vision) প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নে কৌশলগত নেতৃত্ব প্রদান। এই রূপকল্প অবশ্যই জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে।
জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন: প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও কর্মপরিকল্পনায় জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর মৌলিক আদর্শের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষার্থীর সৃজনশীল মেধা ও মনন বিকাশ, বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাশীলতা সৃষ্টি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভূসিত দেশপ্রেমিক, নৈতিকতাসম্পন্ন নাগরিক গঠন।
শিক্ষাক্রম রূপরেখার সমন্বয়: জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এ উল্লিখিত যোগ্যতাভিত্তিক (Competency-based) ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক (Experiential) শিখন-শেখানো পদ্ধতির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য কৌশল প্রণয়ন ও নির্দেশনামূলক নেতৃত্ব প্রদান অপরিহার্য।
পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা (Change Management): নতুন শিক্ষাক্রম, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ডিজিটাল প্রযুক্তি সংযোজনের মতো পরিবর্তনসমূহের সফল বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকবৃন্দের মানসিক প্রস্তুতি, যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে সুসংগঠিত, গ্রহণযোগ্য ও টেকসই করার দায়িত্ব অধ্যক্ষের।
২. একাডেমিক উৎকর্ষ ও শিক্ষাক্রম ব্যবস্থাপনা (Academic Excellence & Curriculum Management)
শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান: ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রমে নির্ধারিত শিখনকালীন মূল্যায়ন (Continuous Assessment) ও সামষ্টিক মূল্যায়ন (Summative Assessment) পদ্ধতিসমূহের উপর অধ্যক্ষের সুস্পষ্ট ও গভীর জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এই মূল্যায়ন পদ্ধতিসমূহ সঠিক ও সমতার সাথে প্রয়োগের জন্য শিক্ষকদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া (Feedback) ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে হবে।
শিক্ষক পেশাদারি উন্নয়ন: বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (NTRCA) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্তসহ সকল শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত ও প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম, শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (ICT) প্রয়োগ, সমন্বিত শিক্ষা (Inclusive Education), শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা (Classroom Management) এবং বিষয়ভিত্তিক পদ্ধতিগত বিষয়ে প্রশিক্ষণ আয়োজনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
গঠনমূলক একাডেমিক তত্ত্বাবধান (Constructive Academic Supervision): অধ্যক্ষের দায়িত্ব কেবল আনুষ্ঠানিক পরিদর্শন নয়, বরং গঠনমূলক একাডেমিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতি আরও কার্যকর, আকর্ষণীয় ও শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক করে তোলায় সহায়তা করা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (NCTB) কর্তৃক প্রণীত শিক্ষক সহায়িকা (Teacher’s Guide) ও নির্দেশনাবলীর যথাযথ অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. আইনানুগ প্রশাসনিক ও আর্থিক সুশাসন (Legal Administrative & Financial Governance)
গভর্নিং বডি/ব্যবস্থাপনা কমিটির সুশাসন: শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রদত্ত নীতিমালা ও নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত মেয়াদে গভর্নিং বডি বা ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, এর নিয়মিত সভা আহ্বান ও পরিচালনা এবং গৃহীত আইনসম্মত সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কমিটির সকল কার্যবিবরণী (Meeting Minutes) যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক।
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আইনি অনুশাসন: শিক্ষক ও কর্মচারীদের চাকরি বিধিমালা, মাসিক পay অর্ডার (MPO) নীতিমালা, ছুটি প্রবিধান, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ, শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকারি আইন, বিধি ও প্রবিধান কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। যেকোনো প্রকার স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাত বা অন্যায় প্রভাবমুক্ত থেকে ন্যায়নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার সাথে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করতে হবে।
আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: প্রতিষ্ঠানের সমুদয় আয়-ব্যয়ের হিসাব সরকার নির্ধারিত পদ্ধতি ও হিসাববিজ্ঞানের নীতিমালা অনুসরণ করে সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। নিয়মিত আর্থিক নিরীক্ষা (Audit) সম্পাদন এবং গভর্নিং বডি, অভিভাবক প্রতিনিধি ও প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আর্থিক কার্যক্রমের স্বচ্ছ প্রতিবেদন উপস্থাপনের মাধ্যমে জবাবদিহিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৪. কার্যকর যোগাযোগ ও অংশীজনের সম্পৃক্ততা (Effective Communication & Stakeholder Engagement)
অভিভাবক-শিক্ষক সমিতির (PTA) কার্যকরীকরণ: প্রতিষ্ঠানের নীতি প্রণয়ন, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও শিক্ষার্থীদের সার্বিক কল্যাণে অভিভাবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ অভিভাবক-শিক্ষক সমিতি (Parent-Teacher Association – PTA) গঠন ও পরিচালনা করতে হবে। PTA কে কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং অংশীদারিত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের উন্নয়ন: শিক্ষার্থীদের একাডেমিক অগ্রগতি, মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতা ও ব্যক্তিগত বিকাশে সহায়তার জন্য একটি আস্থাভিত্তিক, উন্মুক্ত ও সহনশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা, দায়িত্ববোধ ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে ছাত্র সংসদ/স্টুডেন্টস কাউন্সিলকে উৎসাহিত ও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে।
বহিঃস্থ প্রতিষ্ঠান ও সম্প্রদায়ের সাথে সংযোগ: উপজেলা/জেলা শিক্ষা অফিস, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে সক্রিয় ও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সহজতর, সম্পদ সংগ্রহ এবং সামাজিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে।
উপসংহার: বহুমাত্রিক নেতৃত্বের ভূমিকা
আধুনিক বাংলাদেশের শিক্ষা পরিসরে অধ্যক্ষের ভূমিকা গতানুগতিক প্রশাসকের সীমানা অতিক্রম করেছে। তিনি একইসাথে একজন কৌশলিক পরিকল্পনাকারী (Strategic Planner), একাডেমিক নির্দেশক (Academic Mentor), আইনানুগ সুশাসক (Legal Administrator) এবং সামাজিক সম্প্রীতি নির্মাতা (Community Builder)। উপর্যুক্ত পেশাদার দক্ষতা, আইনগত প্রজ্ঞা ও নৈতিক দৃঢ়তার সমন্বয়ে একজন অধ্যক্ষই তার প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রযাত্রায় একটি গৌরবোজ্জ্বল ও টেকসই স্তম্ভে পরিণত করতে সক্ষম হবেন।