প্রতারণার বড়শি: আপনি বা আপনার সন্তান কি ‘ফিশিং’-এর শিকার হচ্ছেন?

কখনো কি আপনার সাথে এমন হয়েছে যে, পরিচিত কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের নাম ব্যবহার করে মেসেঞ্জারে কেউ বিপদের কথা বলে টাকা চেয়েছে? অথবা কোনো কোম্পানির কর্মকর্তা সেজে ফোন করে আপনার গোপন পিন বা পাসওয়ার্ড জানতে চেয়েছে? যদি এর উত্তর “হ্যাঁ” হয়, তবে আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ হয়তো ‘ফিশিং’ নামক এক ডিজিটাল প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

মাছ ধরার জন্য যেমন বড়শিতে টোপ ব্যবহার করা হয়, তেমনি ইন্টারনেটেও প্রতারকরা বিভিন্ন টোপ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক হিসেবে আমাদের সবার এই ডিজিটাল প্রতারণা সম্পর্কে জানা এবং সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।

‘ফিশিং’ আসলে কী?

ফিশিং হলো এক ধরনের সাইবার অপরাধ। এখানে প্রতারকরা ইমেইল, মেসেজ বা ফোন কলের মাধ্যমে আপনার বিশ্বস্ত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের (যেমন: ব্যাংক, বিকাশ বা আপনার বন্ধু) ছদ্মবেশ ধারণ করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো আপনাকে প্রলুব্ধ করে বা ভয় দেখিয়ে আপনার ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য, যেমন—পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ডের বিবরণ বা অ্যাকাউন্টের পিন নম্বর জেনে নেওয়া।

প্রতারণার কিছু সাধারণ কৌশল:

  • পরিচিতজনের ছদ্মবেশ: সবচেয়ে পরিচিত উপায় হলো, আপনার কোনো বন্ধুর ফেসবুক বা মেসেঞ্জার আইডি হ্যাক করে তার বিপদের কথা বলে টাকা চাওয়া।

  • কর্মকর্তার অভিনয়: “আমি বিকাশ/নগদ অফিস থেকে বলছি, আপনার অ্যাকাউন্ট যাচাই করতে পিন নম্বরটি বলুন”—এই ধরনের ফোনকল একটি সাধারণ ফিশিং কৌশল।

কীভাবে চিনবেন ফিশিংয়ের ফাঁদ? (শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়)

১. অবিশ্বাস্য ও লোভনীয় অফার: “আপনি আইফোন জিতেছেন” বা “লাখ টাকার লটারি পেয়েছেন”—এই ধরনের মেসেজ বা ইমেইল পেলে সতর্ক হোন। মনে রাখবেন, সহজে পাওয়া কোনো কিছুর পেছনেই সাধারণত ফাঁদ পাতা থাকে। শিক্ষার্থীদের এই লোভনীয় অফারগুলো সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি।

২. জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করা: “মাত্র ৫ মিনিটের অফার” বা “এখনি তথ্য আপডেট না করলে আপনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাবে”—এরকম মেসেজ দিয়ে আপনাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে তাড়াহুড়ো না করে শান্ত থাকুন। নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো কখনো এভাবে জরুরিভিত্তিতে তথ্য চায় না।

৩. ভয় দেখানো: অনেক সময় প্রতারকরা আপনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ভয় দেখায়। আতঙ্কিত না হয়ে বার্তাটি কোথা থেকে এসেছে, তা ভালোভাবে যাচাই করুন। প্রয়োজনে সরাসরি সেই প্রতিষ্ঠানের হেল্পলাইনে ফোন করে নিশ্চিত হন।

৪. সন্দেহজনক লিঙ্ক বা ফাইল: অনেক সময় মেসেজে বা ইমেইলে দেখতে প্রায় আসল ওয়েবসাইটের মতো একটি লিঙ্ক দেওয়া থাকে, কিন্তু এর বানানে সামান্য ভুল থাকে (যেমন: bankofarnerica.com এর বদলে bankofamerica.com)। আবার, অপরিচিত ইমেইলে আসা কোনো অ্যাটাচমেন্ট (ফাইল) কখনোই খুলবেন না। এগুলোর মাধ্যমে আপনার ডিভাইসে ভাইরাস প্রবেশ করানো হতে পারে।

করণীয়:

  • যাচাই করুন: টাকা পাঠানোর আগে বা ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়ার আগে অবশ্যই সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি ফোন করে নিশ্চিত হন।

  • সন্দেহজনক লিঙ্কে ক্লিক করবেন না: কোনো অফার বা তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে গুগলে সার্চ করে তাদের আসল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন।

  • আলোচনা করুন: অভিভাবক হিসেবে সন্তানদের সাথে এবং শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের সাথে এসব বিষয় নিয়ে নিয়মিত কথা বলুন। তাদের ডিজিটাল দুনিয়ার বিপদগুলো চেনাতে সাহায্য করুন।

সচেতনতাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। আসুন, আমরা ডিজিটাল প্রতারণার এই বড়শি থেকে নিজেকে ও আমাদের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখি।

About Admin

Check Also

আমাদের সন্তানের কাঁধে বইয়ের অসহনীয় বোঝা: একটি নীরব যন্ত্রণার গল্প

প্রতিদিন সকালে শহরের ব্যস্ত রাস্তার এক কোণে, ছোট্ট মেয়ে রিয়ার হাত ধরে স্কুলের গেটের দিকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Skip to toolbar