প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও গোপালগঞ্জ: এক ঐতিহাসিক সফরের উপাখ্যান

ভূমিকা: ইতিহাসের ধুলোমাখা পথে

ইতিহাস কেবল সাল-তারিখের নীরস বিবরণ নয়; এটি মানুষের গল্প, সময়ের স্রোতে বোনা এক রঙিন চাদর। এই চাদরের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে সাহস, বিতর্ক, ভালোবাসা আর সংঘাতের কত শত কাহিনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমনই এক উল্লেখযোগ্য এবং গভীর আবেদনময় অধ্যায় হলো রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গোপালগঞ্জ সফর।

গোপালগঞ্জ—এই নামটি উচ্চারিত হলেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখ, টুঙ্গিপাড়ার ছায়া-সুনিবিড় গ্রাম আর আওয়ামী লীগের রাজনীতির এক পবিত্রতীর্থের ছবি। ঠিক তেমনি, জিয়াউর রহমান নামটি বললেই মনে পড়ে একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর সেনানী, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর প্রবক্তা এবং দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার কথা। বাংলাদেশের রাজনীতির দুই বিপরীত মেরুর এই দুই প্রতীকের সংযোগ যখন ঘটে, তখন তা এক সাধারণ ঐতিহাসিক ঘটনার চেয়ে অনেক বেশি কিছু হয়ে ওঠে।

জিয়াউর রহমানের গোপালগঞ্জ সফর নিয়ে বহু বছর ধরে নানা কথা প্রচলিত। কেউ বলেন, তিনি সেখানে বাধার মুখে পড়েছিলেন; আবার কেউ বলেন, তাঁকে সাদরে গ্রহণ করা হয়েছিল। এই প্রবন্ধে আমরা সবরকম রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে, কেবল ঐতিহাসিক তথ্য ও বাস্তবতার আলোকে সেই দিনগুলোর গল্প শুনব। আমাদের উদ্দেশ্য—সত্যকে খুঁজে বের করা এবং সেই সময়ের বাংলাদেশকে বোঝা, যা আমাদের বর্তমানকে বুঝতে সাহায্য করবে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: যে সময়ে এই গল্পের জন্ম

গল্পটি বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে। সেটি ছিল এক ঝড়ো সময়। দেশের বুকে ঘটে গেছে এক অভাবনীয় বিয়োগান্তক ঘটনা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানা অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন জিয়াউর রহমান। একজন সেন কর্মকর্তা থেকে তিনি হয়ে ওঠেন দেশের রাষ্ট্রপতি। তাঁর কাঁধে তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত, বিভক্ত একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার বিশাল দায়িত্ব।

তিনি একদিকে যেমন বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করেন, তেমনই অন্যদিকে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর এক নতুন দর্শন নিয়ে দেশের মানুষের সামনে আসেন। তাঁর ১৯-দফা কর্মসূচির মূল কথা ছিল—গ্রামের উন্নয়ন, স্বনির্ভরতা অর্জন এবং নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। খাল খনন, গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা আর গণশিক্ষার মতো কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন। তাঁর এই ‘মাটি ও মানুষের রাজনীতি’ অল্প সময়েই তাঁকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়।

কিন্তু তাঁর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জে নিজের নেতৃত্ব ও উন্নয়ন দর্শনকে পৌঁছে দেওয়া। গোপালগঞ্জ সফর ছিল তাঁর জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। এই সফরের সাফল্য বা ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করছিল তিনি কি সত্যিই সারা দেশের নেতা হয়ে উঠতে পারবেন, নাকি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন।

আলো-আঁধারের উপাখ্যান: গোপালগঞ্জ সফর ও সত্যের সন্ধান

জিয়াউর রহমানের গোপালগঞ্জ সফর নিয়ে যে দুটি প্রধান প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে, তা হলো:

১. তিনি কি আদৌ গোপালগঞ্জ গিয়েছিলেন?

২. তাঁকে কি বাধার মুখে পড়ে সাঁজোয়া যানে ফিরতে হয়েছিল?

আসুন, ইতিহাসের পাতা থেকে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।

প্রথম প্রশ্ন: সফরের বাস্তবতা

ঐতিহাসিক দলিল, তৎকালীন সংবাদপত্র এবং প্রবীণ ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ থেকে এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কেবল গোপালগঞ্জ সফর করেননি, বরং সেখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির সূচনাও করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং অবিস্মরণীয় ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৮০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি

  • একুশের প্রত্যয়, শিক্ষার আলোয়: দিনটি ছিল মহান ভাষা শহীদ দিবস। সারা দেশ ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বীর সন্তানদের স্মরণ করছে। এমন একটি মহৎ দিনে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শিক্ষার আলো জ্বালানোর ব্রত নিয়ে পৌঁছে যান গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার সাতপাড় গ্রামে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দেশব্যাপী ‘নিরক্ষরতা দূরীকরণ’ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা। তারিখ এবং স্থান—দুটির انتخاب ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষার জন্য যে জাতি রক্ত দিয়েছে, সেই জাতিকে নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করার শপথ নেওয়ার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারির চেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন আর কী হতে পারে?
  • সাতপাড় কেন? এক মানবিক ছোঁয়া: সাতপাড় গ্রামটি ছিল মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের তফসিলি জাতি অধ্যুষিত একটি প্রান্তিক জনপদ। রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষের এমন একটি জেলায় এসে একটি সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত গ্রামকে বেছে নেওয়া ছিল জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী এক পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে তিনি এই বার্তা দিয়েছিলেন যে, তাঁর উন্নয়ন ও ভালোবাসা কোনো ধর্ম, বর্ণ বা রাজনৈতিক পরিচয়ের সীমানায় বাঁধা নয়। তিনি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে সকলের পাশে আছেন।
  • “আজ থেকে সাতপাড় আমার গ্রাম”: সাতপাড়ের মাটিতে পা রেখে জিয়াউর রহমান যা করেছিলেন, তা আজও সেখানকার মানুষের মনে গেঁথে আছে। তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষদের সাথে মাটিতে বসে পড়েন, তাদের ঘরের দাওয়ায় বসে গল্প করেন। এক পর্যায়ে তিনি ঘোষণা দেন, “আজ থেকে সাতপাড় আমার নিজের গ্রাম।” একজন রাষ্ট্রপতির মুখ থেকে এমন আন্তরিক ঘোষণা শুনে উপস্থিত জনতা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। মুহূর্তে রাষ্ট্রপ্রধান ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার সমস্ত প্রোটোকলের দেয়াল ভেঙে যায়। এটি ছিল এক হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত, যা প্রমাণ করে তিনি কেবল শাসক নন, জনগণের বন্ধু হতে চেয়েছিলেন।
  • প্রথম পাঠ, প্রথম অক্ষর: এরপর তিনি নিজে হাতে চক নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ’ লিখে দেশব্যাপী গণশিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এই দৃশ্যটি তৎকালীন সময়ে দেশবাসীকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের অগণিত শিক্ষিত তরুণ-তরুণী নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দানে এগিয়ে এসেছিলেন।

সুতরাং, জিয়াউর রহমানের গোপালগঞ্জ সফর কোনো কল্পকাহিনি নয়, এটি একটি জীবন্ত ও প্রমাণিত ইতিহাস।

দ্বিতীয় প্রশ্ন: সংঘাত ও সাঁজোয়া যানের রহস্য

এবার আসা যাক সবচেয়ে বিতর্কিত প্রশ্নে। তীব্র রাজনৈতিক বৈরিতার সেই সময়ে তাঁর সফর কি পুরোপুরি নিষ্কণ্টক ছিল? তাঁকে ঘিরে কি কোনো প্রতিবাদ হয়নি?

রাজনৈতিক বাস্তবতা বলে, এমন একটি সফরে কিছুটা উত্তেজনা বা প্রতিবাদ থাকা অস্বাভাবিক নয়। আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ বা অসন্তোষ থাকতেই পারে। তবে সেই প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ কি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, দেশের রাষ্ট্রপতিকে সাঁজোয়া যানে করে পালিয়ে আসতে হবে?

এই দাবিটির পক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না। সমসাময়িক জাতীয় বা স্থানীয় কোনো সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে, সরকারি নথিতে বা নিরপেক্ষ কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। বরং কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করলে এই ধারণাটি অমূলক মনে হয়:

  • রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা: একজন রাষ্ট্রপতির সফর, বিশেষ করে এমন একটি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এলাকায়, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে পরিচালিত হয়। এই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে রাষ্ট্রপতির উপর এমন হামলা চালানো প্রায় অসম্ভব।
  • সফরের মাধ্যম: তৎকালীন অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মূলত হেলিকপ্টারেই যাতায়াত করতেন। এটি ছিল দ্রুত এবং নিরাপদ। ফলে সড়কপথে তাঁকে দীর্ঘ সময় ধরে ধাওয়া করার সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত।
  • রাজনৈতিক বয়ান: “সাঁজোয়া যানে পালানোর” গল্পটি মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তৈরি একটি বয়ান, যা সময়ের সাথে মুখে মুখে ছড়িয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপি সমর্থকদের বয়ানে বলা হয়, সামান্য কিছু প্রতিবাদের চেষ্টা হলেও স্থানীয় জনগণ ও জিয়ার সমর্থকদের উপস্থিতিতে তা ব্যর্থ হয়ে যায়।

নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ছোটখাটো রাজনৈতিক প্রতিবাদ বা উত্তেজনা হয়তো ঘটে থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রপতির পালিয়ে আসার মতো বড় কোনো ঘটনা ঘটেনি। এই গল্পটি রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ হিসেবেই টিকে আছে, ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে নয়।

সফরের গভীর তাৎপর্য: কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

জিয়াউর রহমানের গোপালগঞ্জ সফর কেবল একটি সাধারণ সফর ছিল না। এর পেছনে ছিল সুগভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক দর্শন:

  • ঐক্যের বার্তা: প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক দুর্গে গিয়ে তিনি বিভেদের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যের বার্তা দিতে চেয়েছিলেন।
  • উন্নয়নের রাজনীতি: তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, উন্নয়ন কোনো দলের নয়, দেশের সকল মানুষের অধিকার। খাল খনন বা গণশিক্ষা কর্মসূচির মতো কার্যক্রমে তিনি গোপালগঞ্জের মানুষকেও সমান অংশীদার করেছিলেন।
  • “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ”-এর বাস্তবায়ন: হিন্দু-অধ্যুষিত একটি গ্রামকে “আমার গ্রাম” বলে বুকে টেনে নিয়ে তিনি তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন।

শেষ কথা: ইতিহাস থেকে শিক্ষা

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গোপালগঞ্জ সফর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক সাহসী ও অনন্যসাধারণ পদক্ষেপ। এই সফরের গল্প আমাদের শেখায়, রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও দেশের উন্নয়নের জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য একসাথে কাজ করা সম্ভব। কল্পকাহিনি বা রাজনৈতিক অপপ্রচার সময়ের সাথে হয়তো ফিকে হয়ে যাবে, কিন্তু সাতপাড়ের মাটিতে একজন রাষ্ট্রনায়কের রেখে যাওয়া ভালোবাসার চিহ্ন আর শিক্ষার আলো জ্বালানোর সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি চিরকাল অম্লান থাকবে।

ইতিহাসকে যখন আমরা দলীয় চশমা ছাড়া, একটি খোলা মন নিয়ে দেখি, তখন তা আমাদের কেবল তথ্য দেয় না, অনুপ্রেরণাও জোগায়। জিয়াউর রহমানের গোপালগঞ্জ সফর তেমনই এক অনুপ্রেরণার গল্প, যা আজকের প্রজন্মের কাছে নেতৃত্বের সাহস, মানবিকতা ও জাতীয় ঐক্যের এক চমৎকার পাঠ হতে পারে।

About Admin

Check Also

৫২ তাসের ৫২+ খেলা

ভূমিকা একটি সাধারণ ৫২টি তাসের প্যাকেট শুধুমাত্র বিনোদনের উপকরণ নয়, এটি কৌশল, সম্ভাবনা, মনস্তত্ত্ব এবং …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Skip to toolbar