বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা: সংকট, সম্ভাবনা ও উত্তরণের পথ

ভূমিকা

“বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা আইসিইউতে”—এই উক্তিটি একটি কঠোর বাস্তবতা এবং একইসাথে একটি জটিল পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে, যা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গভীরে প্রোথিত। কয়েক দশক ধরে চলমান মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা ব্যবস্থা, ব্যবহারিক শিক্ষার সংকট, গবেষণায় অপ্রতুল বিনিয়োগ এবং বিজ্ঞানমনস্কতার সামাজিক অনুপস্থিতি এই সংকটকে ঘনীভূত করেছে। তবে, এই ধূসর চিত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ এখন একটি রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে। একদিকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার চাপ, অন্যদিকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ এর মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী রূপকল্প বাস্তবায়নের জাতীয় লক্ষ্য। এই প্রেক্ষাপটে, বিজ্ঞান শিক্ষাকে শুধুমাত্র সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো নয়, বরং এর সংকটগুলোকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করে, সাম্প্রতিক সম্ভাবনাগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন এবং একটি টেকসই উত্তরণের পথনির্দেশ করাই এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।

এই প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে এর বর্তমান কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করব। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যান, জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন এবং শিক্ষা গবেষকদের প্রবন্ধের আলোকে আমরা দেখব কীভাবে ব্যবহারিক শিক্ষার অভাব, শিক্ষকের অপ্রতুলতা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থার ত্রুটি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞানবিমুখ করে তুলছে। এরপর আমরা আলোকপাত করব সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলোর দিকে, বিশেষ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২-এর মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ কীভাবে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। সবশেষে, শিল্প ও একাডেমিয়ার মেলবন্ধন, গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে কীভাবে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব, তার একটি বাস্তবসম্মত ও সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করা হবে। এই দীর্ঘ আলোচনা কেবল সমস্যার চিত্রায়ণ নয়, বরং সমাধানের একটি আন্তরিক প্রচেষ্টা।

১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান কাঠামোর বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার বর্তমান সংকট আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়, বরং এর শেকড় প্রোথিত আছে আমাদের ঐতিহাসিক ও কাঠামোগত বাস্তবতার গভীরে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার উত্তরাধিকার, যা মূলত কেরানি তৈরির উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হয়েছিল, তা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক এবং উদ্ভাবনী চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক ছিল।

১.১ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থা:

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশন (১৯৭৪) একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী এবং সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা দিয়েছিল। এই কমিশনের প্রতিবেদনে বিজ্ঞান শিক্ষাকে প্রাথমিক স্তর থেকে বাধ্যতামূলক করার এবং হাতে-কলমে শিক্ষাদানের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাবে এই কমিশনের সুপারিশগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে, শিক্ষাব্যবস্থা মূলত পুরনো পরীক্ষাকেন্দ্রিক কাঠামোর মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে।

১.২ বর্তমান শিক্ষা কাঠামো ও বিজ্ঞান শিক্ষা:

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা কাঠামো তিনটি প্রধান স্তরে বিভক্ত: প্রাথমিক (প্রথম-পঞ্চম শ্রেণি), মাধ্যমিক (ষষ্ঠ-দ্বাদশ শ্রেণি) এবং উচ্চশিক্ষা।

  • প্রাথমিক স্তর: প্রাথমিক স্তরে ‘প্রাথমিক বিজ্ঞান’ নামে একটি সমন্বিত বিজ্ঞান বই পড়ানো হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের পূর্বে এর পঠন-পাঠন মূলত মুখস্থনির্ভর ছিল এবং ব্যবহারিক ক্লাসের কোনো সুযোগ ছিল না। যদিও শিশুদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা তৈরির একটি চেষ্টা পাঠ্যক্রমে ছিল, শ্রেণিকক্ষের বাস্তবতায় তা প্রতিফলিত হতো সামান্যই।
  • মাধ্যমিক স্তর: ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান একটি সমন্বিত বিষয়। নবম-দশম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা—এই তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এখানেই বিজ্ঞান শিক্ষার প্রথম বড় বিভাজনটি ঘটে। বিজ্ঞান শাখায় পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিত—এই বিষয়গুলো পড়ানো হয়। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এই বিভাজন আরও গভীর হয়।
  • উচ্চশিক্ষা: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান, প্রকৌশল, চিকিৎসা, কৃষি ইত্যাদি শাখায় শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। তবে, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে বিজ্ঞানের ভিত্তি দুর্বল হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় গিয়ে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।

২. সংকটের গভীরতা: একটি বহুমাত্রিক ব্যবচ্ছেদ

বিজ্ঞান শিক্ষার সংকটগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটির সাথে অন্যটি নিবিড়ভাবে জড়িত। এর মূল কারণগুলো নিম্নরূপ:

২.১. অবকাঠামোগত সংকট: ‘নামমাত্র’ ল্যাবরেটরি ও ব্যবহারিক শিক্ষার প্রহসন

বিজ্ঞানের প্রাণ হলো তার পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এটিই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত।

  • পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা: বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের বহু মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে কার্যকরী বিজ্ঞানাগার নেই। যেখানে ল্যাবরেটরি রয়েছে, সেখানেও ব্যবহারিক উপকরণ যেমন—অণুবীক্ষণ যন্ত্র, রাসায়নিক দ্রব্য, পরিমাপক যন্ত্র—ইত্যাদির তীব্র সংকট বিদ্যমান। অনেক দামী যন্ত্রপাতি থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ বা ব্যবহারের অভাবে সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে (আনুমানিক তথ্যভিত্তিক উদাহরণ) উঠে আসে যে, মফস্বলের একটি কলেজের রসায়ন ল্যাবে প্রয়োজনীয় রাসায়নিকের অভাবে গত পাঁচ বছরে কোনো টাইট্রেশন পরীক্ষা করানো সম্ভব হয়নি। শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র পরীক্ষার খাতায় কার্যপ্রণালী মুখস্থ করে লিখতে হয়।
  • ফলাফল: এর ফলে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের কাছে একটি তাত্ত্বিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তারা নিউটনের সূত্র মুখস্থ করে, কিন্তু একটি ভার্নিয়ার স্কেল সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শেখে না। ডিএনএ-র গঠন তাদের ঠোঁটস্থ, কিন্তু একটি সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে কোষ পর্যবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতা তাদের হয় না। এটি তাদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি এক ধরনের ভীতি ও অনাগ্রহ তৈরি করে।
২.২. শিক্ষণ পদ্ধতির সংকট: মুখস্থনির্ভরতা ও কোচিং সেন্টার সংস্কৃতি

আমাদের শিক্ষণ পদ্ধতি এখনো মূলত Chalk and Talk পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ।

  • শিক্ষককেন্দ্রিক পাঠদান: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা মূলত বক্তৃতা দেন এবং শিক্ষার্থীরা নিষ্ক্রিয়ভাবে তা শোনে। প্রশ্ন করতে বা নিজস্ব মতামত দিতে তাদের উৎসাহিত করা হয় না। পাঠ্যবইয়ের বাইরে জ্ঞানার্জনের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।
  • কোচিং সেন্টার ও গাইড বই: মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার এই দুর্বলতার সুযোগে দেশব্যাপী কোচিং সেন্টার ও গাইড বইয়ের এক বিশাল বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা দেওয়ার পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত পথে সর্বোচ্চ নম্বর (জিপিএ-৫) পাওয়ার কৌশল শেখায়। তারা বিভিন্ন সম্ভাব্য প্রশ্ন ও তার মুখস্থ-উপযোগী উত্তর তৈরি করে দেয়, যা শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী ও বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।
২.৩. শিক্ষক সংকট: প্রশিক্ষণ, যোগ্যতা ও অনুপ্রেরণার অভাব

বিজ্ঞান শিক্ষার গুণগত মান বহুলাংশে নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতার ওপর। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

  • শিক্ষকের যোগ্যতা ও নিয়োগ: বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (NTRCA)-এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চললেও, অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদানের জন্য উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়া যায় না। গণিত বা পদার্থবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে যোগ্য প্রার্থীর সংকট প্রকট।
  • প্রশিক্ষণের অভাব: শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। বিশেষ করে নতুন প্রযুক্তি বা আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতির সাথে তাদের পরিচিত করার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ অপ্রতুল। যদিও বর্তমানে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য দেশব্যাপী প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে, তবে এর কার্যকারিতা ও ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
  • অনুপ্রেরণার অভাব: শিক্ষকতা পেশার সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য অনেক পেশার তুলনায় কম হওয়ায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই পেশায় আসতে আগ্রহী হন না। এটি বিজ্ঞান শিক্ষার মানোন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা।
২.৪. মূল্যায়ন ব্যবস্থার ত্রুটি: জিপিএ-৫ কেন্দ্রিক অসুস্থ প্রতিযোগিতা

আমাদের দেশের বর্তমান মূল্যায়ন ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিমাপের পরিবর্তে তার মুখস্থ করার ক্ষমতাকে পরিমাপ করে।

  • পরীক্ষার ফলাফল বনাম প্রকৃত জ্ঞান: প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ অর্জন করে। কিন্তু এই ফলাফলের সাথে তাদের প্রকৃত জ্ঞানের বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বহু জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীও ন্যূনতম পাশ নম্বর পেতে ব্যর্থ হয়। এটি প্রমাণ করে যে, আমাদের পাবলিক পরীক্ষাগুলো শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা যাচাই করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ।
  • সমালোচনামূলক চিন্তার অনুপস্থিতি: সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল মুখস্থনির্ভরতা কমানোর জন্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা এখন প্রশ্নের ধরন মুখস্থ করছে। গাইড বইগুলোতে অধ্যায়ভিত্তিক হাজারো সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া থাকে, যা শিক্ষার্থীরা আত্মস্থ করে। ফলে, একটি অজানা বা বাস্তব সমস্যা সমাধানে তাদের দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না।

৩. আশার আলো: সাম্প্রতিক উদ্যোগ ও সম্ভাবনা

গভীর সংকটের মধ্যেও সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগ বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

৩.১. যুগান্তকারী পরিবর্তন: জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে এটিকে একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ২০২৩ সাল থেকে ধাপে ধাপে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

  • অভিজ্ঞতামূলক শিখন (Experiential Learning): নতুন শিক্ষাক্রমের মূল দর্শন হলো অভিজ্ঞতামূলক শিখন। এখানে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার পরিবর্তে হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানের ক্লাসগুলো এখন শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকছে না। শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন প্রজেক্ট তৈরি করছে, বাস্তব জীবনের সমস্যা চিহ্নিত করে তার বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান খুঁজছে। উদাহরণস্বরূপ, ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বই ‘অনুসন্ধানী পাঠ’-এর পাশাপাশি ‘অনুশীলন বই’ দেওয়া হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণমূলক কাজ করে থাকে।
  • ধারাবাহিক মূল্যায়ন: জিপিএ-৫ কেন্দ্রিক অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নতুন শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীর সারা বছরের কার্যক্রম, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, দলগত কাজ, এবং উপস্থাপনার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে, যা সামষ্টিক পরীক্ষার চাপ বহুলাংশে কমিয়ে দেবে।
  • আইনগত ভিত্তি: জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ এবং এর আলোকে প্রণীত পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক সহায়িকা এই পরিবর্তনের আইনগত ও পদ্ধতিগত ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।
৩.২. প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে শিক্ষা ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

  • শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব: সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প’-এর মাধ্যমে দেশের হাজার হাজার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের সাথে পরিচিত হতে পারছে, যা বিজ্ঞান শিক্ষাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে।
  • ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি: জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (NCTB)-এর ওয়েবসাইটে এবং ‘শিক্ষক বাতায়ন’-এর মতো প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ডিজিটাল কনটেন্ট ও ভিডিও লেকচার পাওয়া যাচ্ছে। এটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে।
৩.৩. বিজ্ঞানমনস্কতা বৃদ্ধিতে প্রতিযোগিতা ও উৎসব

শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা তৈরির জন্য দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও কার্যক্রমের আয়োজন করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

  • গণিত ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড: বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড, পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ইত্যাদি আয়োজন এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিযোগিতাগুলোর মাধ্যমে উঠে আসা শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনছে। এটি অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
  • বিজ্ঞান মেলা ও কংগ্রেস: বার্ষিক জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ, এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির মতো বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত শিশু-কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্ভাবনী ক্ষমতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
৩.৪. শিক্ষক ক্ষমতায়ন ও পেশাগত উন্নয়ন

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষকদের প্রস্তুত করা। এ লক্ষ্যে সরকার ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

  • দেশব্যাপী প্রশিক্ষণ: নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর সারা দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষককে পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণে প্রচলিত বক্তৃতা পদ্ধতির পরিবর্তে হাতে-কলমে শেখানোর কৌশলগুলোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
  • অনলাইন প্ল্যাটফর্ম: ‘মুক্তপাঠ’-এর মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন কোর্স উন্মুক্ত করা হয়েছে। ‘শিক্ষক বাতায়ন’ শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের একটি বড় মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

৪. উত্তরণের পথ: একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা

সংকট থেকে সম্ভাবনার পথে যাত্রাকে সফল করতে হলে কিছু সুনির্দিষ্ট, সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

৪.১. নতুন শিক্ষাক্রমের সফল ও টেকসই বাস্তবায়ন

নতুন শিক্ষাক্রমের সাফল্য নির্ভর করছে এর সঠিক প্রয়োগের ওপর। এর জন্য প্রয়োজন:

  • পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ: শিক্ষা খাতে, বিশেষ করে বিজ্ঞান শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়ন, ল্যাবরেটরি স্থাপন ও উপকরণ কেনার জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে।
  • নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুধুমাত্র এককালীন হলে চলবে না। শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন, নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব এবং শিক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়নের সাথে সাথে তাদের জন্য ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের (Continuous Professional Development) ব্যবস্থা করতে হবে।
  • কার্যকর পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন: শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের সমস্যাগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে সমাধান করা সম্ভব হবে।
৪.২. গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বিনিয়োগ বৃদ্ধি

বিজ্ঞান শিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখা।

  • বাজেট বৃদ্ধি: বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি’র অত্যন্ত নগণ্য একটি অংশ গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়। উন্নত বিশ্বের মতো জিডিপি’র অন্তত ১-২ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ করার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
  • গবেষকদের প্রণোদনা: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষকদের জন্য উন্নত ল্যাব, আর্থিক অনুদান এবং আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে।
৪.৩. শিল্প ও শিক্ষাখাতের মেলবন্ধন (Industry-Academia Collaboration)

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা এবং দেশের শিল্প খাতের চাহিদার মধ্যে একটি বড় ব্যবধান রয়েছে। এই ব্যবধান কমাতে হবে।

  • যৌথ গবেষণা প্রকল্প: শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে যৌথ গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন শিল্পের উন্নয়ন হবে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করবে।
  • কারিকুলাম আধুনিকীকরণ: শিল্প খাতের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ের পাঠ্যক্রম নিয়মিতভাবে আধুনিকীকরণ করতে হবে। ইন্টার্নশিপ বাধ্যতামূলক করা একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।
৪.৪. শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় পেশায় পরিণত করা

মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে না পারলে কোনো পরিকল্পনাই সফল হবে না।

  • আলাদা বেতন কাঠামো: শিক্ষকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় ও আলাদা বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি।
  • সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি: শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচারণা চালাতে হবে এবং কৃতী শিক্ষকদের জাতীয় পর্যায়ে সম্মানিত করার উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
৪.৫. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ও বিজ্ঞানকে জনপ্রিয়করণ

বিজ্ঞানকে একটি কঠিন ও ব্যয়বহুল বিষয় হিসেবে দেখার সামাজিক মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।

  • গণমাধ্যমে প্রচারণা: গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন ও অনলাইনে বিজ্ঞানভিত্তিক আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান, তথ্যচিত্র এবং সফল বিজ্ঞানীদের জীবনী প্রচারের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের অনুপ্রাণিত করতে হবে।
  • অভিভাবকদের সচেতনতা: জিপিএ-৫ এর পেছনে না ছুটে সন্তানদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে উৎসাহিত করার জন্য অভিভাবকদের সাথে নিয়মিত কাউন্সেলিং ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা নিঃসন্দেহে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দশকের পর দশক ধরে জমে থাকা সমস্যাগুলো একদিকে যেমন একে “আইসিইউ”-তে ঠেলে দিয়েছিল, তেমনি সাম্প্রতিক সময়ের সাহসী ও যুগোপযোগী পদক্ষেপগুলো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র থেকে একে বের করে এনে এক নতুন সম্ভাবনার পথে চালিত করছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ এই যাত্রার প্রধান চালিকাশক্তি, তবে এর সাফল্য নির্ভর করছে একটি “whole-of-society” দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।

চ্যালেঞ্জগুলো এখনো বিশাল এবং পথটিও বন্ধুর। অবকাঠামোগত ঘাটতি পূরণ, লক্ষ লক্ষ শিক্ষককে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করা এবং সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন আনা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। কিন্তু আমাদের সামনে বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর ভিত্তি হবে একটি জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী এবং প্রযুক্তি-নির্ভর সমাজ, আর সেই সমাজের মূল স্থপতি হবে বিজ্ঞানমনস্ক একটি নতুন প্রজন্ম।

এর জন্য প্রয়োজন সরকার, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং বেসরকারি খাতের একটি ঐক্যবদ্ধ, আন্তরিক ও টেকসই প্রচেষ্টা। যদি গৃহীত পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায় এবং প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনাগুলো মনোযোগ সহকারে বিবেচনা করা হয়, তবে বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা কেবল সংকটই কাটিয়ে উঠবে না, বরং এটিই হবে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। এই রূপান্তরই নিশ্চিত করবে একটি উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বপ্ন।

তথ্যসূত্র:

  • জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (NCTB)।
  • তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, বাংলাদেশ সরকার-এর ওয়েবসাইট।
  • বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির ওয়েবসাইট ও বার্ষিক প্রতিবেদন।
  • ব্যানবেইস (BANBEIS) কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন শিক্ষাগত জরিপ।
  • “ভর্তি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ব্যর্থতা,” দৈনিক প্রথম আলো, বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদন।
  • “কোচিং বাণিজ্য: হুমকির মুখে শিক্ষাব্যবস্থা,” দ্য ডেইলি স্টার, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।

About The Author

About Admin

Check Also

শিক্ষার সহজ পাঠ

পর্ব ৯: পরীক্ষা, নাকি মূল্যায়ন? শিক্ষায় সঠিক মূল্যায়নের গুরুত্ব “শিক্ষার সহজ পাঠ” সিরিজের গত পর্বগুলোতে …

Leave a Reply

error: Content is protected !!
Skip to toolbar