
আমরা সাধারণত শিক্ষাব্যবস্থাকে দেখি কেবল পরীক্ষার ফলাফল বা গ্রেডের মাপকাঠিতে। কিন্তু রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় এমন এক দর্শন লুকিয়ে আছে, যা কেবল শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই নয়, বরং তার মানবিক মর্যাদা এবং প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দেয়। এই দর্শন অনুযায়ী, একজন শিক্ষার্থী যদি পরীক্ষায় কোনো উত্তর না লিখে সাদা খাতাও জমা দেয়, তাকে শূন্যের বদলে ‘২’ নম্বর দেওয়া হয়। এই নিয়মটি আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত মনে হলেও, এর পেছনে রয়েছে গভীর মানবিকতা এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা।
কেন শূন্যের বদলে ২ নম্বর?
এই নিয়মটি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, এর মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং তাদের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থিওদর মেদ্রায়েভের একটি মন্তব্য এই দর্শনের সারমর্ম তুলে ধরে:
“একজন মানুষ এতো শীতের মধ্যে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেছে, গণপরিবহনে চড়ে নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাসে পৌঁছেছে, প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে চেষ্টা করেছে— তাকে কী করে শূন্য দিই! যে তার রাতগুলোতে পড়াশোনা করেছে, কলম-নোটবুক-কম্পিউটার কিনেছে— জীবনধারায় এতো ত্যাগ সাধন করেছে তাকে কী করে শূন্য দিই!”
এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, একজন শিক্ষার্থীকে শূন্য নম্বর না দেওয়ার পেছনে বেশ কিছু যৌক্তিক কারণ রয়েছে:
- প্রচেষ্টার স্বীকৃতি: একজন শিক্ষার্থী শুধু ক্লাসে উপস্থিত থাকার জন্যই অনেক কষ্ট করে। বিশেষ করে রাশিয়ার তীব্র শীতের মধ্যে নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই পরিশ্রমের স্বীকৃতি হিসেবেই তাকে ন্যূনতম নম্বর দেওয়া হয়।
- আর্থিক ও মানসিক বিনিয়োগ: পড়াশোনার জন্য শিক্ষার্থীরা শুধু সময়ই নয়, আর্থিক বিনিয়োগও করে। বই, খাতা, কলম, এমনকি কম্পিউটার কেনার পেছনেও তাদের অর্থ ব্যয় হয়। শূন্য নম্বর এই সকল বিনিয়োগকে অবজ্ঞা করে, যা একজন শিক্ষার্থীর জন্য হতাশাজনক।
- আত্মবিশ্বাস রক্ষা: শূন্য নম্বর শিক্ষার্থীদের মনে গভীর হতাশা তৈরি করে। এটি তাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেয় এবং তারা ওই নির্দিষ্ট বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অন্যদিকে, ন্যূনতম নম্বর তাদের এই বার্তা দেয় যে, তারা পুরোপুরি ব্যর্থ নয়, বরং তাদের প্রচেষ্টাকে সম্মান জানানো হয়েছে। এটি তাদের আবার নতুন করে চেষ্টা করার অনুপ্রেরণা দেয়।
রাশিয়ার গ্রেডিং পদ্ধতি এবং তার পেছনের দর্শন
রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতিটি ৫-পয়েন্ট স্কেলে (৫, ৪, ৩, ২, ১) হয়ে থাকে। এই স্কেলে:
- ৫ (Отлично – Utlichno): চমৎকার বা অসাধারণ ফল।
- ৪ (Хорошо – Khorosho): ভালো ফল।
- ৩ (Удовлетворительно – Udovletvaritel’no): সন্তোষজনক, অর্থাৎ পাশ নম্বর।
- ২ (Неудовлетворительно – Neudovletvoritel’no): অসন্তোষজনক, অর্থাৎ অকৃতকার্য।
- ১ (Плохо – Plokho): অত্যন্ত খারাপ, যা সাধারণত ব্যবহার করা হয় না।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ২ নম্বরটিকে ‘অসফল’ হিসেবে ধরা হলেও, এটি শূন্যের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ব্যর্থতার অনুভূতিকে প্রশমিত করা হয় এবং তাদের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখা হয়। এই পদ্ধতি প্রমাণ করে যে, শিক্ষাব্যবস্থা কেবল জ্ঞান বিতরণের একটি মাধ্যম নয়, বরং শিক্ষার্থীদের মানবিক এবং মানসিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
বাংলাদেশে এর প্রাসঙ্গিকতা: শিক্ষা ও মানবিকতার মেলবন্ধন
আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের ফলাফল প্রধানত গ্রেড এবং নম্বরের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই কম নম্বর বা অকৃতকার্য হলে শিক্ষার্থীদের মনে গভীর হতাশা ও ব্যর্থতার অনুভূতি তৈরি হয়। এতে তারা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং অনেক সময় ভুল পথে পা বাড়ায়। রাশিয়ার এই পদ্ধতি থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নের পাশাপাশি তাদের প্রচেষ্টা এবং মানবিক মর্যাদাকেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
একটি শিক্ষাব্যবস্থা তখনই সফল হয় যখন এটি কেবল ভালো ছাত্র তৈরি করে না, বরং একজন ভালো মানুষ এবং আত্মবিশ্বাসী নাগরিক তৈরি করে। রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার এই মানবিক দিকটি আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, আমাদের নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও মানবিক মূল্যবোধকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত।