বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনি একটি বহুল প্রচলিত এবং একইসাথে বিতর্কিত বিষয়। শ্রেণিকক্ষের বাইরে অর্থের বিনিময়ে পাঠদানকে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ভালো ফলাফলের জন্য অপরিহার্য মনে করেন। তবে মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে এক কঠোর আইনি বাস্তবতা। সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি (স্মারক নং: ১০(২২২)জাতীঃবিঃ/শিক্ষা/প্রশাসন/২০২৩/০২২) আবারও এই বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে। এই প্রবন্ধে আমরা আইনি প্রেক্ষাপট, এর পেছনের কারণ এবং বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করব।
আইন কী বলছে?
অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক হয়তো জানেন না যে, সরকারি বা এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করা সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞপ্তিটি মূলত পূর্ব-বিদ্যমান একাধিক আইন ও নীতির কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। সেগুলো হলো:
- সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯: এই বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায় বা লাভজনক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন না। যেহেতু এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারের কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা পান, তাই এই আইন তাঁদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রাইভেট পড়ানো একটি লাভজনক কাজ, যা তাঁদের মূল দায়িত্বকে বাধাগ্রস্ত করার আশঙ্কা তৈরি করে।
- জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০: দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এই মূলনীতিমালায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, শিক্ষকেরা নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। এই নীতি কোচিং বাণিজ্যকে নিরুৎসাহিত করে এবং শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাকেই মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা ২০১২: এই নীতিমালাটি শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে। এতে বলা হয়, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে প্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য প্রতিষ্ঠানের সীমিত সংখ্যক (সর্বোচ্চ ১০ জন) শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের ব্যাপক অপব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
- সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮: এই বিধিমালার অধীনে, কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তা ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য হবে এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
এই আইনগুলো থেকে এটি পরিষ্কার যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং বা ব্যাচ পরিচালনা করা কেবল অনৈতিক নয়, বরং আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
কেন এই নিষেধাজ্ঞা? এর পেছনের কারণ কী?
আইন বা নীতি সবসময় নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হয়। শিক্ষকদের কোচিং নিষিদ্ধ করার পেছনেও কিছু যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
- স্বার্থের সংঘাত (Conflict of Interest): যখন একজন শিক্ষক তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করান, তখন একটি সরাসরি স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয়। তিনি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে ইচ্ছাকৃতভাবে মনযোগী না হয়ে তাঁর কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের আসতে উৎসাহিত করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ক্লাসে আলোচনা না করে নিজের কোচিংয়ের জন্য জমিয়ে রাখতে পারেন। এটি তাঁর মূল দায়িত্বের সাথে প্রতারণার সামিল।
- বাস্তব উদাহরণ: ধরা যাক, ‘ক’ কলেজের একজন রসায়নের শিক্ষক ক্লাসে একটি জটিল অধ্যায় বিস্তারিতভাবে পড়ালেন না। তিনি শিক্ষার্থীদের বললেন, “এই অংশটুকু অনেক কঠিন, ক্লাসে শেষ করা সম্ভব নয়। তোমরা আমার সান্ধ্যকালীন ব্যাচে এলে ভালো করে বুঝিয়ে দেব।” এখানে ওই শিক্ষক তাঁর সরকারি দায়িত্বকে ব্যবহার করে নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসার সুযোগ তৈরি করছেন।
- শিক্ষায় বৈষম্য সৃষ্টি: কোচিং ব্যবস্থা ধনী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করে। যে শিক্ষার্থীর অভিভাবকের আর্থিক সচ্ছলতা রয়েছে, তিনি একাধিক বিষয়ে কোচিং নিতে পারেন। অন্যদিকে, একজন দরিদ্র কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থী সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এর ফলে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে এক ধরনের কৃত্রিম বৈষম্য তৈরি হয়, যা মেধার প্রকৃত মূল্যায়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
- শ্রেণিকক্ষের গুরুত্ব হ্রাস: কোচিংয়ের ব্যাপক প্রসারের ফলে শ্রেণিকক্ষের গুরুত্ব কমে যায়। শিক্ষার্থীরা ক্লাসের পড়ায় মনোযোগ না দিয়ে কোচিংয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাদের মনে এই ধারণা জন্মায় যে, “ক্লাসে না বুঝলেও সমস্যা নেই, কোচিং-এ তো পড়িয়ে দেবেই।” এটি পুরো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়।
- মানসিক ও আর্থিক চাপ: শিক্ষার্থীদের ওপর কোচিং এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে। ক্লাসের পর আবার কোচিংয়ে দৌড়ানো, বাড়ির কাজের বোঝা—সব মিলিয়ে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, অভিভাবকদের জন্য এটি একটি বড় আর্থিক বোঝা। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে তাঁদের আয়ের একটি বড় অংশ সন্তানদের কোচিংয়ের পেছনে ব্যয় করতে হয়।
বাস্তবতা: আইন কেন কার্যকর হয় না?
আইন থাকা সত্ত্বেও কেন কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে না, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান।
১. অপর্যাপ্ত বেতন: অনেক শিক্ষক যুক্তি দেখান যে, তাঁদের বেতন জীবনযাত্রার মানের তুলনায় অপ্রতুল। তাই বাড়তি আয়ের জন্য তাঁরা কোচিং করাতে বাধ্য হন। যদিও এটি আইনের লঙ্ঘন, তবে এই আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকেও অস্বীকার করার উপায় নেই।
২. দুর্বল পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি: আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর নজরদারির অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠান প্রধান বা পরিচালনা পর্ষদ জেনেও অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না।
৩. সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা: কোচিং এখন আমাদের সমাজে এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে, অনেক অভিভাবকই একে সন্তানের ভালো ফলাফলের জন্য “জরুরি” বলে মনে করেন। তাঁরা নিজেরাই শিক্ষকদের কোচিং করানোর জন্য অনুরোধ করেন বা চাপ দেন।
৪. আইনের ফাঁকফোকর: শিক্ষকেরা অনেক সময় সরাসরি “কোচিং সেন্টার” না খুলে “মডেল টেস্ট সেন্টার” বা “হোম কেয়ার” নামে কার্যক্রম চালান। অনেক সময় নিজের নামে প্রতিষ্ঠান না করে পরিবারের অন্য সদস্যের নামে তা পরিচালনা করেন।
সমাধানের পথ ও “খোলাবই”-এর ভূমিকা
এই জটিল সমস্যার সমাধান একমুখী নয়। এর জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
- শিক্ষকদের বেতন কাঠামো পর্যালোচনা: শিক্ষকদের জন্য একটি সম্মানজনক বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা গেলে তাঁরা কোচিংয়ের দিকে কম ঝুঁকবেন।
- আইনের কঠোর প্রয়োগ: কোনো প্রভাবশালী মহলের চাপ ছাড়া অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।
- বিকল্প শিক্ষাদান পদ্ধতি: দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই অতিরিক্ত বা প্রতিকারমূলক ক্লাসের (Remedial Class) ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যার জন্য শিক্ষকেরা প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট হারে সম্মানী পেতে পারেন।
এই পরিস্থিতিতে “খোলাবই”-এর মতো উন্মুক্ত জ্ঞান প্ল্যাটফর্ম একটি বিপ্লবী ভূমিকা পালন করতে পারে।
- বৈষম্যহীন শিক্ষা: “খোলাবই” সকল শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে মানসম্মত শিক্ষা উপকরণ, ভিডিও লেকচার এবং অনুশীলনী সরবরাহ করে। এর ফলে একজন শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল না হয়েও নিজের ঘাটতি পূরণ করতে পারে।
- জ্ঞানের গণতন্ত্রায়ণ: এটি জ্ঞানকে নির্দিষ্ট শিক্ষকের ব্যক্তিগত সম্পদ হওয়া থেকে বের করে এনে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ফলে কোনো শিক্ষক চাইলেও তথ্যের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করতে পারেন না।
- সহায়ক শিক্ষা: শিক্ষার্থীরা স্কুলের বা কলেজের পড়ার পাশাপাশি নিজেদের সুবিধামত সময়ে “খোলাবই” থেকে পড়ে ধারণা পরিষ্কার করতে পারে, যা তাদের কোচিংয়ের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনে।
উপসংহার
শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য একটি আইনত নিষিদ্ধ এবং অনৈতিক অভ্যাস, যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক বিজ্ঞপ্তিটি সেই আইনি বাধ্যবাধকতার কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। কেবল আইন প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি বৃদ্ধি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে—শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তন। “খোলাবই”-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বিনামূল্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করে এই পরিবর্তনের পথে একটি শক্তিশালী সহযোগী হতে পারে, যা একটি বৈষম্যহীন ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়তা করবে।