Breaking News

শিক্ষার সহজ পাঠ

পর্ব ১: শিক্ষা কী? আইন ও নীতিমালার আলোকে এক বিশ্লেষণ

আমরা সবাই ‘শিক্ষা’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত আইন, নীতি ও বিধিবিধানের আলোকে শিক্ষা বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে, তা নিয়ে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং নীতিনির্ধারক—সবার জন্যই এর প্রাতিষ্ঠানিক সংজ্ঞা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা অপরিহার্য। এই পর্বে আমরা বাংলাদেশের শিক্ষাসংক্রান্ত আইন ও নীতিমালার আলোকে ‘শিক্ষা’ শব্দের আইনি ও প্রায়োগিক সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করব।

আইনের আলোকে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক সংজ্ঞা

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি হলো জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০২৪। এসব নীতি ও আইনি দলিলে শিক্ষাকে একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর প্রস্তাবনায় শিক্ষাকে একটি সামগ্রিক ও বহুমুখী প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি কেবল জ্ঞান অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং শিক্ষার্থীর নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, বিজ্ঞানমনস্ক এবং অর্থনৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোকে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করে।

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ২০২৪ (খসড়া) অনুযায়ী, শিক্ষা বলতে “জ্ঞান, দক্ষতা, সক্ষমতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সামগ্রিক পরিবর্তন সাধনকে” বোঝানো হয়েছে। এই আইন শিক্ষাকে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে এনেছে, যেখানে প্রথাগত শিক্ষা, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা—সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত।

বাস্তবসম্মত প্রেক্ষাপটে শিক্ষার তাৎপর্য

আইনের এই আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞাগুলোকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা যাক।

  • শ্রেণিকক্ষের বাইরেও শিক্ষা: একজন শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু শেখানোর পরিবর্তে দলগত কাজ (Group work), বিতর্ক প্রতিযোগিতা বা খেলাধুলার মতো সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে উৎসাহিত করেন, তখন তিনি শিক্ষানীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বাস্তবায়ন করেন। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহযোগিতা, নেতৃত্ব এবং সামাজিক রীতিনীতি শেখে, যা তাদের সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব গঠনে অপরিহার্য।
  • মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা: একজন শিক্ষার্থী যখন তার শিক্ষকের কাছ থেকে সময়ের মূল্য বা সততার গুরুত্ব সম্পর্কে শেখে এবং তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে, সেটিও শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই ধরনের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
  • জীবনব্যাপী শিক্ষার ধারণা: একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যখন তার পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে কোনো অনলাইন কোর্স করেন বা নতুন কিছু শেখেন, সেটিও আইনের চোখে শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এটি প্রমাণ করে যে শিক্ষা কোনো নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।

কেন এটি জানা জরুরি?

শিক্ষার এই আইনি সংজ্ঞাটি আমাদের সবার জানা প্রয়োজন, কারণ এটি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি পক্ষের দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করে।

  • শিক্ষকের জন্য: এই সংজ্ঞা একজন শিক্ষককে তার শিক্ষণ পদ্ধতিকে কেবল পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক বিকাশের দিকে মনোযোগী হতে উৎসাহিত করে।
  • অভিভাবকের জন্য: এটি একজন অভিভাবককে তার সন্তানের শুধু একাডেমিক সাফল্যের দিকে নজর না দিয়ে তার সামাজিক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের দিকেও সমান গুরুত্ব দিতে অনুপ্রাণিত করে।
  • শিক্ষার্থীর জন্য: এই ধারণা একজন শিক্ষার্থীকে পড়াশোনাকে কেবল বোঝা হিসেবে না দেখে, বরং নিজেকে একজন যোগ্য ও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে দেখতে শেখায়।

পরিশেষে, শিক্ষা শুধু একটি শব্দ বা একটি কার্যক্রম নয়; এটি একটি দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের মূল ভিত্তি। আইন ও নীতিমালার এই সংজ্ঞা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শিক্ষা হলো একটি পবিত্র দায়িত্ব, যা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে প্রভাবিত করে।

তথ্যসূত্র:
  • জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
  • শিক্ষা আইন ২০২৪ (খসড়া), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

About Admin

Check Also

হান্টার কমিশন (১৮৮২): ঔপনিবেশিক ভারতে গণশিক্ষার প্রথম রূপরেখা?

আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে যখন আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলি, তখন আমাদের শিকড়ের দিকে …

Leave a Reply

error: Content is protected !!
Skip to toolbar