পর্ব ১০: বইয়ের বাইরের শিক্ষা: ভবিষ্যতের জন্য দক্ষতা ও প্রস্তুতি
“শিক্ষার সহজ পাঠ” সিরিজের এই পর্যন্ত আমরা শিক্ষার উদ্দেশ্য, পাঠ্যক্রম এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছি। এসব আলোচনার মূল সুর ছিল একটাই—শিক্ষা কেবল পরীক্ষা পাসের জন্য নয়, জীবন গঠনের জন্য।
কিন্তু জীবন ও জীবিকা—উভয়ের ক্ষেত্রেই সফল হওয়ার জন্য কেবল ক্লাসের বইয়ের জ্ঞান যথেষ্ট নয়। আজকের যুগে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসা একজন শিক্ষার্থীকে এমন কিছু দক্ষতা অর্জন করতে হয়, যা কোনো নির্দিষ্ট অধ্যায়ে পাওয়া যায় না। আজকের পর্বে আমরা জানব, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে বইয়ের বাইরে কী কী শিক্ষা ও দক্ষতা আবশ্যক।
কেন বইয়ের বাইরে জীবন দক্ষতা প্রয়োজন?
আমাদের চাকরির বাজার এবং জীবনযাত্রার ধরণ খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। যে চাকরিগুলো এক দশক আগেও ছিল, তার অনেকগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়, আবার নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এই পরিবর্তনশীল বিশ্বে টিকে থাকার জন্য জ্ঞান (Knowledge) এর পাশাপাশি দক্ষতা (Skills) এবং মনোভাব (Attitude)—এই তিনটি জিনিস অপরিহার্য।
একজন শিক্ষার্থী যখন কেবল মুখস্থ করে ভালো ফলাফল করে, তখন সে হয়তো তার শিক্ষাজীবনের একটি ধাপ সফলভাবে অতিক্রম করে। কিন্তু সে যদি বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধান করতে না পারে, তবে সে অর্ধ-শিক্ষিত থেকে যায়।
ভবিষ্যতের জন্য ৫টি আবশ্যক জীবন দক্ষতা
নতুন শিক্ষাক্রমে এই দক্ষতাগুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অভিভাবক ও শিক্ষক হিসেবে আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের এগুলো অর্জনে সাহায্য করা:
১. সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা (Problem-Solving Skills)
স্কুলের অঙ্ক বা বিজ্ঞানের সমস্যার সমাধান নয়, বরং জীবনের ছোট-বড় জটিলতা সামলানোর ক্ষমতা। যেমন: বন্ধুদের সাথে কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য হলে তা কীভাবে সমাধান করবে, বা একটি সীমিত বাজেট কীভাবে ব্যবহার করবে—এসবই সমস্যা সমাধানের অংশ। এই দক্ষতা শেখার জন্য প্রজেক্টভিত্তিক কাজ, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও দলগত কাজ (Group Work) খুবই কার্যকর।
২. যোগাযোগ ও সহযোগিতার দক্ষতা (Communication & Collaboration)
কথাবার্তা, লেখা বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করে তুলে ধরা এবং অন্যদের কথা ধৈর্য ধরে শোনা—এগুলো হলো কার্যকর যোগাযোগের মূল ভিত্তি। বর্তমানে কোনো কাজই এককভাবে করা যায় না। তাই অন্যের সাথে মিলেমিশে কাজ করার (Collaboration) অভ্যাস, অন্যকে সম্মান জানানো এবং একটি টিমে নিজের ভূমিকা বোঝার দক্ষতা খুবই জরুরি।
৩. সমালোচনামূলক চিন্তা (Critical Thinking)
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দের পার্থক্য করা একটি কঠিন কাজ। সমালোচনামূলক চিন্তা হলো কোনো তথ্য বা সিদ্ধান্তকে অন্ধভাবে মেনে না নিয়ে, সেটিকে প্রশ্ন করা, বিশ্লেষণ করা এবং যৌক্তিক প্রমাণ খুঁজে বের করার ক্ষমতা। এই দক্ষতা শিক্ষার্থীদের ভুল তথ্যের (Misinformation) শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করে।
৪. ডিজিটাল ও আর্থিক সাক্ষরতা (Digital & Financial Literacy)
প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার (কেবল গেম খেলা বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার নয়) এবং ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকার জ্ঞান হলো ডিজিটাল সাক্ষরতা। অন্যদিকে, টাকা জমানো, বাজেট তৈরি করা এবং দায়িত্বের সাথে অর্থ খরচ করার জ্ঞান হলো আর্থিক সাক্ষরতা। এই দুটি দক্ষতা ভবিষ্যতের জীবনকে মসৃণ করবে।
৫. আজীবন শেখার মানসিকতা (Lifelong Learning/Growth Mindset)
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হলো কৌতূহল ধরে রাখা এবং শেখার প্রতি আগ্রহ না হারানো। শেখা কেবল স্কুল-কলেজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নতুন কিছু জানার বা বোঝার জন্য সবসময় উন্মুক্ত থাকা, ভুল থেকে শেখা এবং নিজেদের উন্নতির জন্য কাজ করে যাওয়া—এই মানসিকতাই একজন শিক্ষার্থীকে সারাজীবন সফল হতে সাহায্য করবে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের করণীয়
আপনার সন্তানের কেবল ভালো ফলাফল নয়, বরং জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়াটাও নিশ্চিত করুন:
- খেলাধুলা ও ক্লাব কার্যক্রমে উৎসাহিত করুন: বিতর্ক, স্কাউটিং বা রেড ক্রিসেন্টের মতো সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সহযোগিতা ও নেতৃত্ব শেখা যায়।
- ‘কেন’ প্রশ্নটি করতে দিন: কেবল উত্তর নয়, তার পেছনের কারণ বা যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করুন।
- ভুল করতে দিন: ছোটখাটো ভুল হলে তাকে বকা না দিয়ে, ভুল থেকে কীভাবে শেখা যায় তা আলোচনা করুন।
- পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই দিন: বিজ্ঞান, ইতিহাস বা জীবনীমূলক বই পড়তে দিন।
পরিশেষে, একটি সার্টিফিকেট আপনাকে চাকরি পেতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু জীবন দক্ষতাগুলো আপনাকে সেই চাকরিতে টিকে থাকতে এবং জীবনে সাফল্য অর্জন করতে সাহায্য করবে। তাই শিক্ষার আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, যারা কেবল তথ্য মুখস্থ করে না, বরং সমস্যা সমাধান করতে জানে এবং পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে পারে।
শিক্ষার্থী হিসেবে আপনার সবচেয়ে পছন্দের ‘বইয়ের বাইরের দক্ষতা’ কোনটি?