পর্ব ৪: অভিভাবকের ভূমিকা—সন্তানের শিক্ষায় একজন অভিভাবকের দায়িত্ব
“শিক্ষার সহজ পাঠ” সিরিজের আগের পর্বগুলোতে আমরা জেনেছি একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, একজন শিক্ষকের ভূমিকা কী এবং একজন শিক্ষার্থীর অধিকার ও দায়িত্ব কী। কিন্তু শিক্ষার এই যাত্রায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো অভিভাবক। একজন অভিভাবক কেবল সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নন, বরং তার ভূমিকা আরও বিস্তৃত ও গভীর। আজকের পর্বে আমরা জানব, জাতীয় শিক্ষানীতি ও বাস্তবতার আলোকে একজন অভিভাবকের দায়িত্ব কী এবং কীভাবে তিনি সন্তানের শিক্ষায় একজন কার্যকর অংশীদার হতে পারেন।
অভিভাবক: একজন সহযোগী ও পথপ্রদর্শক
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন আর শুধু স্কুল-কেন্দ্রিক নয়। একটি শিশুর শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, শিক্ষাকে কার্যকর করার জন্য পরিবার ও সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এর অর্থ হলো, শিক্ষকের যেমন শ্রেণিকক্ষে ভূমিকা রয়েছে, তেমনি অভিভাবকেরও রয়েছে বাড়িতে ভূমিকা। তিনি সন্তানের শেখার প্রক্রিয়ায় একজন সহযোগী এবং তার সার্বিক বিকাশে একজন গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শক।
অভিভাবকের মূল দায়িত্বগুলো
সন্তানের সফলতার পেছনে অভিভাবকের কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে, যা তার সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলে:
- বাড়িতে শেখার অনুকূল পরিবেশ তৈরি: শুধু স্কুল নয়, বাড়িকেও শেখার একটি নিরাপদ ও আকর্ষণীয় স্থান করে তোলা জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে—সন্তানের পড়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় ও জায়গা বরাদ্দ করা, টেলিভিশন বা ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার সীমিত করা এবং তার জিজ্ঞাসু মনকে উৎসাহিত করা। নিয়মিত গল্প বলা বা বই পড়ে শোনানোও এর অংশ।
- শিক্ষকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ: সন্তান কেমন শিখছে, তার কী সমস্যা হচ্ছে বা কোন বিষয়ে তার বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন—এই সবকিছু জানতে অভিভাবকের নিয়মিত শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা প্রয়োজন। অভিভাবক-শিক্ষক সভার (PTM) মতো মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে সন্তানের অগ্রগতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা উচিত। এতে সমস্যা চিহ্নিত করা এবং দ্রুত সমাধান করা সহজ হয়।
- শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার প্রতি মনোযোগ: শিক্ষা শুধু মস্তিষ্কের নয়, শরীর ও মনেরও বিষয়। একজন শিক্ষার্থীর পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক চাপমুক্ত জীবন নিশ্চিত করা অভিভাবকের মৌলিক দায়িত্ব। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, শিল্পকলা বা অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহ দিয়ে তার মানসিক বিকাশকে সহায়তা করা প্রয়োজন।
- ভালো অভ্যাসের রোল মডেল হওয়া: শিশুরা বড়দের কাছ থেকে শেখে। একজন অভিভাবক যদি নিজে বই পড়েন, সময় মেনে চলেন, এবং সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তবে সেই মূল্যবোধগুলো সন্তানের মধ্যেও সহজে সঞ্চারিত হয়। আপনার আচরণই আপনার সন্তানের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
- ভুল থেকে শেখার সুযোগ দেওয়া: শিশুরা ভুল করবে, এটি স্বাভাবিক। অভিভাবকের দায়িত্ব হলো সেই ভুলকে বকাঝকার বদলে শেখার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা। তাকে বোঝানো, কেন ভুল হয়েছে এবং কীভাবে তা থেকে শেখা যায়। এটি তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা তৈরি করে।
পরিশেষে, একটি শিশুর শিক্ষা কোনো একক ব্যক্তির দায়িত্ব নয়। এটি শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক—এই তিন স্তম্ভের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। একজন অভিভাবক যখন তার দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করেন, তখন তিনি কেবল তার সন্তানের ভবিষ্যৎই উজ্জ্বল করেন না, বরং একটি উন্নত সমাজ গঠনেও সরাসরি অবদান রাখেন।