
পর্ব ৫: সমাজের দায়িত্ব—একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজের ভূমিকা
“শিক্ষার সহজ পাঠ” সিরিজের এই পর্যন্ত আমরা শিক্ষার মূল ভিত্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি—শিক্ষা কী, একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর ভূমিকা এবং সর্বোপরি, অভিভাবকের দায়িত্ব। কিন্তু শিক্ষার এই বৃহৎ কাঠামোটি শুধু এই কয়েকটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। এর পেছনে রয়েছে একটি বিশাল শক্তি, যা হয়তো আমরা সবসময় উপলব্ধি করি না। আর সেই শক্তিটি হলো সমাজ।
একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শুধু সরকার, শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন একটি সচেতন ও দায়িত্বশীল সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ। আজকের পর্বে আমরা জানব, একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজের ভূমিকা কী এবং কীভাবে প্রতিটি নাগরিক তার নিজস্ব অবস্থান থেকে শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে পারে।
শিক্ষা: সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বলা আছে, “শিক্ষা কোনো একক পক্ষ বা সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি একটি সামগ্রিক সামাজিক দায়িত্ব।” এই উক্তির মাধ্যমে বোঝা যায়, একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেই দেশের মানুষেরই প্রতিফলন। যখন একটি সমাজ শিক্ষা, শিক্ষক ও জ্ঞানকে গুরুত্ব দেয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী হয়।
সমাজের এই দায়িত্বগুলো শুধু আর্থিক সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি সামগ্রিক মানসিকতা ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন।
সমাজ ও সম্প্রদায়ের মূল ভূমিকাগুলো
একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সমাজের কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে, যা স্কুল ও পরিবারের পরিধি ছাড়িয়ে যায়:
- শিক্ষককে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া: শিক্ষকরাই একটি উন্নত জাতি গঠনের কারিগর। যখন একটি সমাজ শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়, তখন এই পেশায় যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তিরা আকৃষ্ট হন। সমাজের এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষকদের কাজে আরও বেশি অনুপ্রেরণা জোগায়।
- স্কুল ব্যবস্থাপনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ: স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি (School Management Committee – SMC) এবং অভিভাবক-শিক্ষক সমিতি (Parent-Teacher Association – PTA) হলো স্কুল ও সমাজের মধ্যে সেতুবন্ধন। স্থানীয় জনগণ ও অভিভাবকরা এই কমিটিগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে স্কুলের চাহিদা, সমস্যা ও উন্নয়নের ব্যাপারে সরাসরি মতামত দিতে পারেন। এর মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আরও জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর হয়।
- নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি: একটি সমাজের দায়িত্ব হলো স্কুল এবং এর আশেপাশে এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে কোনো ধরনের বৈষম্য, হয়রানি বা সহিংসতা থাকবে না। ছেলে বা মেয়ে, গরিব বা ধনী, জাতি বা ধর্ম নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীর জন্য একটি নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।
- স্থানীয় সম্পদ দিয়ে সহায়তা করা: অনেক সময় স্থানীয় কমিউনিটিগুলো তাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে স্কুলকে সাহায্য করতে পারে। যেমন—একটি পুরোনো ভবন সংস্কার, লাইব্রেরির জন্য বই কেনা বা খেলার মাঠ তৈরি করা। সমাজের সামান্য উদ্যোগও একটি স্কুলের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
- জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি গড়ে তোলা: একটি শিক্ষিত সমাজ শুধু সাক্ষরতাকে বোঝায় না, বরং বোঝায় জ্ঞানচর্চার একটি সামগ্রিক সংস্কৃতি। এলাকার পাঠাগারকে সক্রিয় রাখা, কুইজ বা বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া—এসবের মাধ্যমে সমাজে জ্ঞানার্জনের একটি সুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়।
পরিশেষে,
একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা হলো একটি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর এই সম্পদকে কেবল সরকারের হাতে ছেড়ে দিলে হবে না। সমাজের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব রয়েছে তার নিজের স্থান থেকে শিক্ষাকে সমর্থন করা, উৎসাহিত করা এবং উন্নত করা। যখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সমাজ—সবাই মিলে এক ছাতার নিচে কাজ করবে, তখনই একটি শক্তিশালী ও টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।