পর্ব ৬: রাষ্ট্রের দায়িত্ব—আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারের ভূমিকা
“শিক্ষার সহজ পাঠ” সিরিজের গত পর্বগুলোতে আমরা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরের অংশীজনদের—শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সমাজ—এর ভূমিকা ও দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু এই সমস্ত স্তম্ভকে একটি সুতোয় বাঁধার এবং একটি সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্বটি কার? উত্তরটি হলো রাষ্ট্র বা সরকার।
একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে, তার দর্শন কী হবে এবং সেই দর্শনকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চূড়ান্ত দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আজকের সমাপনী পর্বে আমরা জানব, একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা বিনির্মাণে রাষ্ট্রের ভূমিকা কতখানি এবং সরকারের প্রধান দায়িত্বগুলো কী কী।
রাষ্ট্র: শিক্ষাব্যবস্থার অভিভাবক ও নিয়ন্ত্রক
রাষ্ট্র হলো শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ অভিভাবক। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা তার অন্যতম প্রধান সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্রকে কিছু মৌলিক ভূমিকা পালন করতে হয়।
আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারের প্রধান দায়িত্বসমূহ
- শিক্ষানীতি ও আইন প্রণয়ন: একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কোন পথে চলবে, তার জন্য একটি সুস্পষ্ট শিক্ষানীতি এবং আইন থাকা অপরিহার্য। সরকার এই নীতি ও আইন প্রণয়ন করে, যা শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠ্যক্রম, মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ করে। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এবং প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন এই দায়িত্বেরই প্রতিফলন।
- শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা: রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো দেশের প্রতিটি শিশুর জন্য শিক্ষার সুযোগ অবারিত করা। এর মধ্যে রয়েছে—বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান, নারী শিক্ষার প্রসার, এবং প্রত্যন্ত ও সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলের শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা। বিনামূল্যে বই বিতরণ এবং উপবৃত্তির মতো কর্মসূচিগুলো এই লক্ষ্যেরই অংশ।
- শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ: শুধু শিক্ষার সুযোগ তৈরি করলেই হবে না, সেই শিক্ষার মান বজায় রাখাও জরুরি। সরকার বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার মাধ্যমে স্কুলগুলোর শিক্ষার মান পর্যবেক্ষণ করে, শিক্ষকদের যোগ্যতা নির্ধারণ করে এবং পাঠ্যক্রমের কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে। এর মাধ্যমে পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় একটি ন্যূনতম মান বজায় রাখা সম্ভব হয়।
- অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন: স্কুল ভবন নির্মাণ, আধুনিক শ্রেণিকক্ষ তৈরি, বিজ্ঞানাগার, লাইব্রেরি এবং খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।
- শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন: শিক্ষকরাই শিক্ষাব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। তাই তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এর মাধ্যমে শিক্ষকরা নতুন শিক্ষাদান পদ্ধতি, প্রযুক্তি এবং বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হন, যা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকে আরও কার্যকর করে তোলে।
- পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ: উপরের সবগুলো দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান। শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা এবং সেই বাজেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি জাতি তার未来的 জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করে।
<
p style=”text-align: justify;”>পরিশেষে, একটি সফল শিক্ষাব্যবস্থা হলো একটি সম্মিলিত যাত্রার ফসল। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজ নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলেও, রাষ্ট্র যখন তার নিয়ন্ত্রক ও অভিভাবকের ভূমিকাটি সঠিকভাবে পালন করে, তখনই সেই যাত্রা তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। একটি সুশিক্ষিত জাতি গঠনের মাধ্যমে একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার চাবিকাঠি রাষ্ট্রের হাতেই নিহিত।