শিক্ষার সহজ পাঠ

পর্ব ৭: পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য—মুখস্থ বিদ্যা নয়, দক্ষতা অর্জন

“শিক্ষার সহজ পাঠ” সিরিজের গত ছয়টি পর্বে আমরা শিক্ষা ব্যবস্থার মূল স্তম্ভগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি—শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সমাজ এবং রাষ্ট্র। কিন্তু এই সমস্ত অংশীজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টার চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? এর উত্তর লুকিয়ে আছে পাঠ্যক্রমের মধ্যে। পাঠ্যক্রমই নির্ধারণ করে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে এবং কীভাবে শিখবে।

আজকের পর্বে আমরা আলোচনা করব পাঠ্যক্রমের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী। এর লক্ষ্য কি শুধু পরীক্ষার জন্য কিছু তথ্য মুখস্থ করা, নাকি এর চেয়েও গভীর কিছু?

পাঠ্যক্রম কী ও কেন?

সহজ ভাষায়, পাঠ্যক্রম হলো একটি সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত শিক্ষাপদ্ধতি। এটি শুধু পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু নয়, বরং শেখার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া—শ্রেণিকক্ষে কী শেখানো হবে, কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে কোন ধরনের দক্ষতা ও মূল্যবোধ তৈরি হবে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা।

একটি কার্যকর পাঠ্যক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য হলো একজন শিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র তথ্য দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া নয়, বরং তাকে জীবনের জন্য প্রস্তুত করা।

মুখস্থ বিদ্যা বনাম দক্ষতা অর্জন

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে মুখস্থ বিদ্যার একটি সংস্কৃতি বিদ্যমান। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার ভালো ফল করার জন্য বইয়ের তথ্য মুখস্থ করে এবং পরীক্ষায় তা হুবহু লিখে দেয়। এই পদ্ধতি সাময়িক সাফল্য দিলেও এর কিছু দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর দিক রয়েছে:

  • সমালোচনাধর্মী চিন্তার অভাব: মুখস্থ বিদ্যা শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা বা বিশ্লেষণ করতে শেখায় না।
  • সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ না হওয়া: মুখস্থ করা তথ্যের বাইরে নতুন কিছু চিন্তা করার আগ্রহ বা ক্ষমতা তৈরি হয় না।
  • সমস্যা সমাধানের অদক্ষতা: বাস্তব জীবনের কোনো জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য শুধু মুখস্থ জ্ঞান যথেষ্ট নয়।

এর বিপরীতে, একটি আধুনিক ও কার্যকর পাঠ্যক্রম দক্ষতা অর্জনের উপর জোর দেয়। এর লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীকে এমন কিছু দক্ষতা শেখানো যা তাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করবে। এই দক্ষতাগুলো হলো:

  • সমস্যা সমাধান ও বিশ্লেষণ: কোনো সমস্যাকে নানা দিক থেকে দেখা এবং তার যৌক্তিক সমাধান বের করা।
  • যৌক্তিক ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা: কোনো তথ্য বা ঘটনাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে তার সত্যতা যাচাই করা।
  • যোগাযোগ দক্ষতা: নিজের ভাবনা ও মতামত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারা।
  • ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান: বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখা।
  • দলগতভাবে কাজ করার মানসিকতা: অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার অভ্যাস।

নতুন পাঠ্যক্রমের দর্শন

বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসছে। নতুন পাঠ্যক্রমে মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে অভিজ্ঞতামূলক ও দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এখানে শিক্ষকের ভূমিকা কেবল তথ্য সরবরাহ করা নয়, বরং শিক্ষার্থীদেরকে সক্রিয়ভাবে শেখার জন্য উৎসাহিত করা। একইভাবে, শিক্ষার্থীর ভূমিকাও কেবল শ্রোতার নয়, বরং অনুসন্ধানী ও অংশগ্রহণকারীর।

পরিশেষে,একটি জাতির ভবিষ্যৎ শুধু তার জনসংখ্যার ওপর নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে সেই জনসংখ্যার শিক্ষা ও দক্ষতার ওপর। যখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শুধুমাত্র পরীক্ষা পাসের সনদ নয়, বরং বাস্তব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা তৈরি করবে, তখনই আমাদের জাতি সত্যিকার অর্থে উন্নত হবে। তাই এখন সময় এসেছে মুখস্থ বিদ্যাকে বিদায় জানিয়ে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাকে স্বাগত জানানোর।

About The Author

About Admin

Check Also

মৃত্যুর পর ভাই-বোনের আর দেখা হবে না: একটি ভুল ধারণা

আমাদের সমাজে এমন অনেক কথা প্রচলিত আছে, যার কোনো ভিত্তি ইসলামে নেই। ‘মৃত্যুর পর ভাই-বোনের …

Leave a Reply

error: Content is protected !!
Skip to toolbar