পর্ব ৯: পরীক্ষা, নাকি মূল্যায়ন? শিক্ষায় সঠিক মূল্যায়নের গুরুত্ব
“শিক্ষার সহজ পাঠ” সিরিজের গত পর্বগুলোতে আমরা পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করেছি—কীভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন মুখস্থবিদ্যা থেকে দক্ষতা ও প্রয়োগের দিকে ঝুঁকছে। আমরা দেখেছি, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের কেবল তথ্য মুখস্থ করার বদলে সেটির ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু যদি শিক্ষার লক্ষ্য হয় দক্ষতা অর্জন, তবে সেই দক্ষতার মাপকাঠি বা পরীক্ষার পদ্ধতিও বদলানো জরুরি। আজকের পর্বে আমরা জানব, কেন শুধু ‘পরীক্ষা’ যথেষ্ট নয় এবং কেন আমাদের ‘মূল্যায়ন’ প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
পরীক্ষা বনাম মূল্যায়ন: পার্থক্য কোথায়?
শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন দুটি শব্দই ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এদের উদ্দেশ্য এবং প্রভাব ভিন্ন:
১. পরীক্ষা (Exam):
পরীক্ষা সাধারণত ফলাফল-ভিত্তিক (Result-based) হয়। এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে (যেমন, সেমিস্টার শেষে) শিক্ষার্থীর মুখস্থ করার ক্ষমতা এবং সীমিত জ্ঞান পরিমাপ করে। এর মূল প্রশ্নটি হলো: “শিক্ষার্থী কী মুখস্থ করেছে?” এটি মূলত একটি একক বিচার বা রায় দেওয়ার প্রক্রিয়া।
২. মূল্যায়ন (Assessment/Evaluation):
মূল্যায়ন হলো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া (Continuous Process)। এটি শিক্ষার্থীর শিখন প্রক্রিয়া, দক্ষতা, দুর্বলতা এবং অগ্রগতিকে নিয়মিতভাবে পরিমাপ করে। এর মূল প্রশ্নটি হলো: “শিক্ষার্থী কী করতে পারে, কতটা বুঝতে পারে এবং কীভাবে সেই জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারে?” মূল্যায়ন হলো শেখার একটি হাতিয়ার, যা শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়কেই দিকনির্দেশনা দেয়।
সঠিক মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা
একটি কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার জন্য পরীক্ষা নয়, সঠিক মূল্যায়ন অপরিহার্য। এর গুরুত্ব তিন স্তরে অনুভূত হয়:
১. শিক্ষার্থীর জন্য:
- চাপ হ্রাস: কেবল একটি দিনের ফলাফলের ওপর নির্ভর না করে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ফলে পরীক্ষার চাপ কমে।
- গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া (Constructive Feedback): কেবল নম্বর বা গ্রেড নয়, মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থী জানতে পারে তার দুর্বলতা কোথায় এবং কীভাবে সে উন্নতি করতে পারে। এটি ভুল থেকে শেখার সুযোগ তৈরি করে।
২. শিক্ষকের জন্য:
- শিক্ষণ পদ্ধতির কার্যকারিতা যাচাই: শিক্ষক বুঝতে পারেন, তার পড়ানোর পদ্ধতি কতটা কার্যকর হচ্ছে। যদি বেশিরভাগ শিক্ষার্থী একটি বিষয়ে খারাপ করে, তবে শিক্ষক তার পদ্ধতি পরিবর্তন করতে পারেন।
- শিক্ষার্থীকে জানা: শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত প্রয়োজন এবং শেখার গতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পান।
৩. শিক্ষাব্যবস্থার জন্য:
- লক্ষ্য অর্জন: মূল্যায়ন নিশ্চিত করে যে পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে যে দক্ষতাগুলো শেখানোর লক্ষ্য ছিল, তা শিক্ষার্থীরা সত্যিই অর্জন করেছে কি না।
- নীতিনির্ধারণ: মূল্যায়নের ফলাফল শিক্ষা নীতির সংস্কার এবং উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে।
মূল্যায়নের আধুনিক পদ্ধতি
আধুনিক মূল্যায়ন পদ্ধতি দুই প্রকারের ওপর জোর দেয়:
- ফর্ম্যাটিভ অ্যাসেসমেন্ট (Formative Assessment): এটি শিখন চলাকালীন (During Learning) করা হয়। যেমন: ক্লাসের কুইজ, দৈনন্দিন কাজ, আলোচনা, বাড়ির কাজ বা ক্লাসে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ফিডব্যাক দেওয়া। এটি উন্নতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট (Summative Assessment): এটি শিখন শেষে (After Learning) করা হয়। তবে এটি প্রথাগত পরীক্ষার মতো শুধু মুখস্থের ওপর জোর না দিয়ে, প্রজেক্ট, প্রেজেন্টেশন, হাতে-কলমে কাজ (Practical), এবং প্রয়োগ-ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সামগ্রিক দক্ষতা পরিমাপ করে।
পরিশেষে, আমাদের বুঝতে হবে যে শিক্ষা কোনো রেস নয়, এটি একটি জীবনব্যাপী যাত্রা। এই যাত্রায় পরীক্ষা হলো একটি সাময়িক যাচাই, কিন্তু মূল্যায়ন হলো পথের নির্দেশিকা। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি মূল্যায়ন ব্যবস্থা তৈরি করা, যা শিক্ষার্থীদের ভীতিমুক্ত পরিবেশে নিজেদের পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়তা করবে এবং তাদের শুধুমাত্র ভালো পরীক্ষার্থী নয়, বরং দক্ষ ও যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে।