Breaking News

সিরিজ: বাংলাদেশে শিক্ষার রূপান্তর: ফিরে দেখা পঞ্চাশ বছরের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট

পর্ব-১: কেন এই আলোচনা: বাংলাদেশের শিক্ষা কমিশনগুলোর প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতা

শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড—এই বহুল প্রচলিত কথাটি কেবল একটি বাগধারা নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্মাণের মূল ভিত্তি। একটি দেশের জনগণ কেমন হবে, তাদের চিন্তার ধরণ, মেধা, মনন ও দক্ষতার মান কোন স্তরে পৌঁছাবে, তা নির্ভর করে সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই একটি যুগোপযোগী এবং গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের চেষ্টা চলেছে। এই চেষ্টার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হলো বিভিন্ন সময়ে গঠিত শিক্ষা কমিশন।

“বাংলাদেশে শিক্ষার রূপান্তর: ফিরে দেখা পঞ্চাশ বছরের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট” শিরোনামে আমাদের এই ধারাবাহিক যাত্রায় আমরা চেষ্টা করবো স্বাধীন বাংলাদেশের সকল শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনগুলো ফিরে দেখতে। আমাদের উদ্দেশ্য কেবল রিপোর্টগুলোর সারসংক্ষেপ তুলে ধরা নয়, বরং প্রতিটি কমিশনের পেছনের প্রেক্ষাপট, মূল দর্শন, সুপারিশমালার শক্তি ও দুর্বলতা এবং তার বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করা। আজ, এই সিরিজের সূচনা পর্বে, আমরা আলোচনা করবো কেন এই ফিরে দেখা প্রয়োজন এবং কোন ঐতিহাসিক পথ ধরে আজকের অবস্থানে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি।

ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার: ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পর্ব

স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার শিকড় প্রোথিত আছে এর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের ইতিহাসের গভীরে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসকদের প্রশাসনিক কাজে সহায়তার জন্য একটি অনুগত কেরানি শ্রেণি তৈরি করা। ১৮৮২ সালের হান্টার কমিশন বা ১৯১৭ সালের স্যাডলার কমিশনের মতো উদ্যোগগুলো শিক্ষার প্রসারে কিছুটা ভূমিকা রাখলেও এর মূল দর্শন ছিল ঔপনিবেশিক কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখা।

এরপর আসে পাকিস্তান পর্ব। ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া এই অবাস্তব রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মানুষের উপর প্রথম আঘাতটিই আসে শিক্ষার মাধ্যমে। ১৯৫৯ সালে গঠিত শরিফ কমিশন (প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের গঠিত কমিশন) ছিল সেই শোষণমূলক নীতির একটি নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। এই কমিশন অবৈজ্ঞানিক ‘স্তরভিত্তিক’ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তাব করে, যেখানে সাধারণ মানুষের জন্য উচ্চশিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দুর্লভ হয়ে যেত। এর বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালে এ দেশের ছাত্রসমাজ এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে, যা ইতিহাসে ‘বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন’ নামে পরিচিত। এই আন্দোলনই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।

স্বাধীনতার স্বপ্ন ও নতুন শিক্ষা দর্শন

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এই স্বাধীনতা কেবল একটি ভূখণ্ডের বিজয় ছিল না; এটি ছিল শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক আদর্শিক বিজয়। ১৯৭২ সালে প্রণীত আমাদের সংবিধানের মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—একটি নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখায়।

এই নতুন রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন ছিল এক নতুন প্রজন্মের, যারা হবেন বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক কাঠামোর শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে এই নতুন মানুষ গড়া সম্ভব ছিল না। তাই অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল এমন একটি শিক্ষা দর্শন প্রণয়ন করা, যা সংবিধানের চেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা এদেশের মাটি ও মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করবে। এই অপরিহার্যতা থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষা কমিশন গঠনের যাত্রার সূচনা হয়।

শিক্ষা কমিশন কী এবং কেন?

সহজ কথায়, শিক্ষা কমিশন হলো সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একদল বিশেষজ্ঞের একটি কমিটি। এই কমিটির প্রধান কাজ হলো দেশের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা, এর সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো চিহ্নিত করা এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি সুসংগঠিত, দীর্ঘমেয়াদী ও বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা বা সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করা।

এটি অনেকটা একজন চিকিৎসকের মতো, যিনি রোগীর পুরো শরীর পরীক্ষা করে তার রোগ নির্ণয় করেন এবং আরোগ্যের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপত্র দেন। শিক্ষা কমিশনও তেমনি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক ‘স্বাস্থ্য’ পরীক্ষা করে এর ‘চিকিৎসার’ জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করে।

আমাদের পথচলার সূচনা

আজকের এই আলোচনা ছিল আমাদের দীর্ঘ যাত্রার প্রথম ধাপ। আমরা দেখলাম, কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে স্বাধীন বাংলাদেশে একটি নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়েছিল। আগামী পর্ব থেকে আমরা সরাসরি প্রবেশ করবো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী শিক্ষা কমিশন—ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন, ১৯৭৪-এর আলোচনায়।

আগামী শুক্রবার চোখ রাখুন ‘খোলাবই’-এর পাতায়।

পাঠক ভাবনা ও আলোচনা

এই ধারাবাহিকটি কেবল তথ্যের সমাবেশ নয়, এটি একটি সম্মিলিত চিন্তার প্রয়াস। তাই আপনাদের অংশগ্রহণ আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আজকের প্রশ্ন: পাকিস্তান আমলের শিক্ষা ব্যবস্থার কোন বৈশিষ্ট্যগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বলে আপনি মনে করেন?

আপনার মতামত আমাদের জানান নিচের কমেন্ট বক্সে অথবা ‘খোলাবই’-এর ফেসবুক পেজে।

  • তথ্যসূত্র: 
  • মূল শিক্ষা কমিশন রিপোর্টসমূহ (১৯৭৪, ১৯৮৮, ১৯৯৭, ২০০১, ২০০৯)।
  • 'বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাস' সম্পর্কিত একাডেমিক গ্রন্থ (যেমন: ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রমুখের লেখা)।
  • বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের গবেষণা প্রবন্ধ ও বিশ্লেষণ।
  • জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০।
  • পত্রিকার আর্কাইভ (দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ ইত্যাদি)।
  • Hunter Commission Report - BYJU'S (https://byjus.com/free-ias-prep/hunter-commission-report/)
  • National Education Commission 1959 | PDF - Scribd (https://www.scribd.com/presentation/525370851/1610007687-National-Education-Commission-1959-1)
  • The Colonial Legacy of Bangladesh's Education System - Litteramag (https://litteramag.net/colonial-legacy-of-bangladeshs-education-system/)
  • Tale of Education Policy in Bangladesh: Development, Changes... - UniversePG (https://www.universepg.com/bjah/tale-of-education-policy-in-bangladesh-development-changes-and-adaptation-approach)
  • Historical Development of Secondary Education in Bangladesh - ERIC (https://files.eric.ed.gov/fulltext/EJ1066070.pdf)
  • [Solved] Define the term education commission... - Studocu (https://www.studocu.com/row/messages/question/11145475/define-the-term-education-commission-as-used-in-history-of-education)

About Admin

Check Also

প্রতারণার বড়শি: আপনি বা আপনার সন্তান কি ‘ফিশিং’-এর শিকার হচ্ছেন?

কখনো কি আপনার সাথে এমন হয়েছে যে, পরিচিত কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের নাম ব্যবহার করে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Skip to toolbar