আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে যখন আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলি, তখন আমাদের শিকড়ের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। সেই ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো, যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে নানা উদ্যোগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর সংস্কারের প্রচেষ্টা। ঔপনিবেশিক ভারতে শিক্ষা নিয়ে যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে হান্টার কমিশন (১৮৮২) ছিল অন্যতম। চলুন, সহজ ভাষায় জেনে নেওয়া যাক কী ছিল এই কমিশন, কেন এটি গঠন করা হয়েছিল এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে এর প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী।
কেন এলো হান্টার কমিশন?
হান্টার কমিশন বোঝার জন্য এর ঠিক আগের প্রেক্ষাপটটা জানা জরুরি। ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘উডের ডেসপ্যাচ’ নামে শিক্ষার এক সনদ প্রকাশ করে, যেখানে প্রথমবারের মতো প্রাথমিক ও দেশীয় শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে ঘটল তার উল্টো। সরকারি মনোযোগ ও অর্থ বরাদ্দ—দুই-ই চলে গেল মূলত উচ্চশিক্ষা এবং গুটিকয়েক শহুরে স্কুল-কলেজের পেছনে। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তা অবহেলিতই থেকে গেল।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড রিপন, যিনি কিছুটা উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যে এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের সাথে ঔপনিবেশিক সরকারের দূরত্ব আরও বাড়বে। শিক্ষার ভিত যদি মজবুত না হয়, তাহলে ওপরের কাঠামো শক্তিশালী হবে না। এই চিন্তা থেকেই তিনি ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থা পর্যালোচনার জন্য একটি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
গঠন ও পরিচিতি
১৮৮২ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টারের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের ‘ভারতীয় শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা হয়। সভাপতির নামানুসারেই এটি ‘হান্টার কমিশন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই কমিশনের তাৎপর্য ছিল এর গঠনে। এতে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ভারতীয় সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যা ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আনন্দমোহন বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং কে.টি. তেলাং-এর মতো ব্যক্তিত্বরা এর সদস্য ছিলেন। তাঁদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিল যে, এই কমিশনের সুপারিশে ভারতীয়দের দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রতিফলন থাকবে।
কমিশন প্রায় এক বছর ধরে পুরো ভারত ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে এবং ১৮৮৩ সালে ৬০০ পৃষ্ঠার এক বিশাল রিপোর্ট পেশ করে, যেখানে মোট ২২২টি সুপারিশ ছিল।
হান্টার কমিশনের মূল সুপারিশগুলো কী ছিল?
হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলো ছিল ব্যাপক। একে একে না বলে, চলুন এর মূল ধারণাগুলো বুঝে নিই:
১. প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব: কমিশনের সবচেয়ে যুগান্তকারী সুপারিশ ছিল এটিই। তারা পরিষ্কারভাবে বলে, প্রাথমিক শিক্ষাই হলো ‘গণশিক্ষা’ এবং এর দায়িত্ব সরকারের।
- ভাষা: মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে।
- পাঠ্যক্রম: পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে গিয়ে সাধারণ বিজ্ঞান, গণিত, কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিল্পের মতো জীবনমুখী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
- দায়িত্ব: প্রাথমিক শিক্ষার ভার জেলা বোর্ড বা পৌরসভার মতো স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে তুলে দিতে হবে, যাতে স্থানীয় মানুষ নিজেদের শিক্ষার ব্যাপারে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
২. মাধ্যমিক শিক্ষায় দুটি ধারা: কমিশন বুঝতে পেরেছিল যে, মাধ্যমিক পাশ করে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় না। তাই তারা মাধ্যমিক শিক্ষাকে দুটি ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়:
- ‘এ’ কোর্স: এটি ছিল সাধারণ সাহিত্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীদের মূলত উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত করবে।
- ‘বি’ কোর্স: এটি ছিল বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষে সরাসরি কর্মজীবনে প্রবেশের জন্য তৈরি করবে। আজকের যুগেও এই ধারণাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
৩. উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ: কমিশন সুপারিশ করে যে, সরকার নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠা না করে বরং বেসরকারি উদ্যোগে কলেজ প্রতিষ্ঠায় আর্থিক অনুদান দিয়ে সাহায্য করবে। সরকারের কাজ হবে কেবল কিছু আদর্শ কলেজ পরিচালনা করা এবং শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করা।
৪. নারী ও মুসলিমদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা:
- নারীশিক্ষা: মেয়েদের জন্য আলাদা স্কুল স্থাপন, নারী পরিদর্শক নিয়োগ, পাঠ্যক্রম সহজ করা এবং নারী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা ট্রেনিং স্কুলের সুপারিশ করা হয়।
- মুসলিম শিক্ষা: কমিশন লক্ষ্য করে যে, মুসলিম সম্প্রদায় শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে। তাই তাদের জন্য আলাদা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কলেজে বিশেষ সুবিধার কথা বলা হয়।
৫. ধর্মনিরপেক্ষতা ও নৈতিক শিক্ষা: কমিশন সুপারিশ করে যে, সরকারি স্কুলগুলোতে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মশিক্ষা দেওয়া হবে না, তবে সব স্তরে নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
প্রভাব ও সীমাবদ্ধতা: একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন
হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলো নিঃসন্দেহে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি নতুন চিন্তার জন্ম দিয়েছিল।
গুরুত্ব:
- এই প্রথম সরকারিভাবে প্রাথমিক শিক্ষাকে গণমানুষের শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
- শিক্ষার দায়িত্ব স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হাতে দেওয়ার প্রস্তাবটি ছিল বিকেন্দ্রীকরণের পথে একটি বড় পদক্ষেপ।
- বৃত্তিমূলক শিক্ষার ধারণাটি ছিল অত্যন্ত আধুনিক, যদিও তা তখন সেভাবে সফল হয়নি।
সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা:
- কমিশন অনেক ভালো সুপারিশ করলেও সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য অর্থ কোথা থেকে আসবে, তার কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়নি। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার আশানুরূপ হয়নি।
- শিক্ষা অবৈতনিক বা বাধ্যতামূলক করার কোনো কথা বলা হয়নি, যা গণশিক্ষা প্রসারে একটি বড় বাধা ছিল।
- মুসলিমদের জন্য পৃথক শিক্ষার সুপারিশটি ভালো উদ্দেশ্যে করা হলেও, সমালোচকদের মতে, এটি পরবর্তীকালে ভারতীয় সমাজে বিভাজনের রাজনীতিকে উসকে দিতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল।
- বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার ফলে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয় এবং অনেক মানহীন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
শেষ কথা
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হান্টার কমিশনকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এটিই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা যা ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে শুধু অভিজাতদের গণ্ডি থেকে বের করে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। এর অনেক সুপারিশ তখন বাস্তবায়িত না হলেও, পরবর্তী প্রায় একশ বছর ধরে এই অঞ্চলের শিক্ষানীতি প্রণয়নে এর প্রভাব ছিল অসামান্য। মাতৃভাষায় শিক্ষা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ বা নারীশিক্ষার মতো বিষয়গুলো, যা নিয়ে আজ আমরা কথা বলি, তার আনুষ্ঠানিক আলোচনার সূচনা করেছিল এই কমিশন। তাই বাংলাদেশের শিক্ষার রূপান্তরের ইতিহাস বুঝতে হলে হান্টার কমিশনের পাঠ অত্যন্ত জরুরি।