Share
Related Articles
মানুষের জীবনে এমন কিছু স্মৃতি থাকে, যা সময়ের ধুলোয় কখনও ম্লান হয় না। বরং বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই স্মৃতিগুলো আরও উজ্জ্বল, আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। ফেলে আসা পথের দিকে তাকালে মনে হয়, সে পথ যেন কোনো সাধারণ পথ ছিল না, ছিল এক স্বপ্নিল উপত্যকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ তেমনি এক স্বপ্নময় অধ্যায়ের নাম তার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছে। এটি কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম নয়, এটি একটি ‘আনন্দপুরী’—যেখানে জ্ঞান, শৃঙ্খলা, স্নেহ এবং শাসন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এই প্রতিষ্ঠানের বিশাল মাঠ, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ভবন, শিক্ষকদের স্নেহমাখা শাসন আর সহপাঠীদের সঙ্গে কাটানো অজস্র মুহূর্ত নিয়ে গড়ে ওঠা এক জগত, যা প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মানসপটে আজও অমলিন।
এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হলো, একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণকে আশ্রয় করে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে সেই সময়, সেই প্রতিষ্ঠান এবং তার কারিগরদের অবদানকে তুলে ধরা। এখানে ব্যক্তিগত আবেগ ও অভিজ্ঞতাকে একটি সার্বজনীন রূপ দিয়ে, তৃতীয় পক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হবে—কীভাবে এই শিক্ষকেরা কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান নয়, বরং জীবনবোধ এবং মূল্যবোধেরও শিক্ষা দিতেন। তাঁদের পাঠদান পদ্ধতির মনস্তাত্ত্বিক কার্যকারিতা এবং তার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য আলোচনা উপস্থাপন করাই এই লেখার মূল লক্ষ্য। ‘খোলা বই’ প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য, এই লেখাটি কেবল একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্মৃতিচারণ নয়, বরং বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার এক স্বর্ণালী অধ্যায়ের প্রতিচ্ছবি, যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পাথেয় হতে পারে।
কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় কেবল তার একাডেমিক সাফল্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, তার ভৌগোলিক অবস্থান শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনে এক গভীর প্রভাব ফেলে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ এই দিক থেকে ছিল অনন্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ক্যাম্পাসের একটি অংশে অবস্থিত হওয়ায় এর শিক্ষার্থীরা এক ভিন্নধর্মী পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেত।
প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠানটি কেবল একটি ইট-পাথরের কাঠামো নয়, বরং প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশাল খেলার মাঠ, যার এক পাশে ঘন সবুজ পাহাড়ের সারি, অন্য পাশে একাডেমিক ভবন—এই দৃশ্যই ছিল তাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জায়গাটি, যেখানে “যেমন খুশি তেমন সাজো” অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলত, তা কেবল একটি স্থান ছিল না, ছিল কৈশোরের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা আর অফুরন্ত আনন্দের এক প্রতীক। প্রকৃতির এই উদার সান্নিধ্য শিক্ষার্থীদের মনকে সংবেদনশীল ও কল্পনাপ্রবণ করে তুলত। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, একটি শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশে জ্ঞানার্জনের সুযোগ তাদের মননকে বিকশিত হতে সাহায্য করত। আবুল ভাইয়ের পরিচর্যায় গড়ে ওঠা ফুলের বাগান শুধু সৌন্দর্যই ছড়াত না, শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃতিপ্রেম ও নান্দনিকতাবোধেরও জন্ম দিত।
প্রতিষ্ঠানটির কিছু কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যও শিক্ষার্থীদের স্মৃতিতে বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছে। যেমন—পশ্চিমের সিঁড়ি। এটি কেবল ওঠানামার জন্য একটি পথ ছিল না, এটি ছিল বহু ছাত্রছাত্রীর আড্ডা, গল্প আর স্বপ্নের সাক্ষী। আবার, এসএসসি পরীক্ষার সময় কেন্দ্রের চারপাশে ১৪৪ ধারা জারি হলে যে বাঁশের বেড়া দেওয়া হতো, তা ছিল কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণের এক আনুষ্ঠানিক প্রতীকের মতো। এই বেড়া একদিকে যেমন পরীক্ষার গাম্ভীর্য ও গুরুত্বকে নির্দেশ করত, অন্যদিকে তেমনি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সফলভাবে শেষ করার এক অদম্য স্পৃহাকেও জাগিয়ে তুলত। হারুন ভাইয়ের ঘন্টার ধ্বনি ছিল সময়ের অনুবর্তিতার প্রতীক। সেই ধ্বনি শুনে ক্লাসে ফেরা, টিফিনের জন্য দৌড়ে যাওয়া বা ছুটির আনন্দে উদ্বেলিত হওয়া—এই সবই ছিল সেই আনন্দপুরীর দৈনন্দিন জীবনের সুর।
এই পরিবেশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের যৌথ চেতনা (Collective Consciousness) তৈরি করেছিল। তারা নিজেদেরকে কেবল একজন শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, বরং এক বৃহত্তর পরিবারের সদস্য হিসেবে ভাবতে শিখেছিল। এই পরিবারই ছিল তাদের ‘আনন্দপুরী’।
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আত্মা হলেন তার শিক্ষকেরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজের সৌভাগ্য ছিল যে, তারা এমন একদল নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক পেয়েছিলেন, যাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন একেকজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁদের পাঠদান পদ্ধতি, শৃঙ্খলা রক্ষার কৌশল এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মানসিক সংযোগ স্থাপনের ভঙ্গি ছিল ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল এক ও অভিন্ন—আদর্শ মানুষ তৈরি করা। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের স্মৃতি থেকে উঠে আসা কয়েকজন শিক্ষকের পাঠদান পদ্ধতির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিচে তুলে ধরা হলো।
নূর আহমেদ স্যার: শৃঙ্খলার মূর্ত প্রতীক ও নির্ভুলতার কারিগর
প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা নূর আহমেদ স্যারকে স্মরণ করেন তাঁর শৌর্য, বীর্য এবং দাপটের জন্য। তাঁর হাতে থাকা ‘ছোট মিয়া’ নামক স্কেলটি ছিল শিক্ষার্থীদের কাছে একাধারে ভীতি ও শ্রদ্ধার বস্তু। স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ইংরেজি Application লেখার সময় ‘To’-এর পরে কমা দেওয়ার ভুল সংশোধনের জন্য তিনি পুরো ক্লাসে সেই স্কেল হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
বিশ্লেষণ:
এই ঘটনাটিকে আপাতদৃষ্টিতে কঠোর মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ শিক্ষণ কৌশল। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘Negative Reinforcement’ বা নেতিবাচক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সঠিক আচরণকে স্থায়ী করা। ‘ছোট মিয়া’র ভয় ছাত্রছাত্রীদের মনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, তারা সেই নির্দিষ্ট ভুলটি জীবনে আর কখনও করেনি। এটি কেবল একটি কমার ব্যবহার শেখা ছিল না, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে খুঁটিনাটি বিষয়েও নির্ভুল ও সচেতন হওয়ার এক অলিখিত শিক্ষা ছিল। নূর আহমেদ স্যার তাঁর ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছিলেন যে, জ্ঞানার্জনের পথে সামান্যতম ভুল বা অমনোযোগিতাও ক্ষমার অযোগ্য। এই কঠোর শৃঙ্খলাই পরবর্তী জীবনে তাদের কর্মক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তি স্থাপন করে দিয়েছিল।
মাজহারুল ইসলাম স্যার: শিল্পের তুলিতে আনন্দের পাঠ
ড্রইং স্যার মাজহারুল ইসলাম ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার একজন শিক্ষক। তাঁর ক্লাস ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য এক মুক্তির প্রাঙ্গণ। তিনি কেবল পাঠ্যবইয়ের নির্দিষ্ট আঁকায় সীমাবদ্ধ থাকতেন না, বরং শিল্পের বিশাল জগতকে তাদের সামনে উন্মোচিত করতেন।
বিশ্লেষণ:
মাজহারুল ইসলাম স্যারের শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল ‘Constructivist Learning Theory’-এর এক চমৎকার উদাহরণ, যেখানে শিক্ষার্থীরা সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শেখে। ‘দুটো ডিম দিয়ে পাখি’ বা ‘কয়েকটি সরলরেখা দিয়ে শাপলা’ আঁকার কৌশল শেখানোর মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীদের এটা বোঝাতে চাইতেন যে, সৃজনশীলতার জন্য খুব জটিল উপকরণের প্রয়োজন হয় না। সাধারণ জিনিসের মধ্যেই অসাধারণ সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে, শুধু দেখার মতো চোখ থাকা চাই। যারা ভালো আঁকতে পারত না, তাদের খাতা নিয়েও তিনি হাসির খোরাক যোগাতেন, কিন্তু কখনও নিরুৎসাহিত করতেন না। এর মাধ্যমে তিনি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) ক্লাসরুম তৈরি করেছিলেন, যেখানে প্রত্যেকেই নিজের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অংশগ্রহণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। তিনি শিখিয়েছিলেন, শিল্প কেবল প্রতিভাবানদের জন্য নয়, শিল্প সবার জন্য—এটি আত্মপ্রকাশের একটি মাধ্যম।
মাহমুদুল হক স্যার: উচ্চারণে নিখুঁত, ব্যক্তিত্বে অনন্য
ইংরেজি শিক্ষক মাহমুদুল হক স্যার ছিলেন একজন পরিপূর্ণতাবাদী (Perfectionist)। ইংরেজি উচ্চারণের প্রতি তাঁর নিখুঁত দৃষ্টিভঙ্গি ছাত্রদের কাছে কখনও কখনও অস্বস্তির কারণ হলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল সমীহ জাগানো। ‘Bangladesh’-কে ‘ব্যংলোদেশ’ উচ্চারণ করার স্মৃতি প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মনে করিয়ে দেয় উচ্চারণের শুদ্ধতার প্রতি তাঁর uncompromising মনোভাব।
বিশ্লেষণ:
মাহমুদুল হক স্যারের এই পদ্ধতি বর্তমান সময়ের ‘Phonetics’ বা ধ্বনিবিজ্ঞানের গুরুত্বকেই তুলে ধরে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একজন শিক্ষক যখন উচ্চারণের এত গভীরে প্রবেশ করতেন, তা ছিল এককথায় যুগান্তকারী। শিক্ষার্থীরা তখন এর গুরুত্ব পুরোপুরি অনুধাবন করতে না পেরে হয়তো আড়ালে হাসত, কিন্তু অবচেতনভাবেই তাদের মনে সঠিক উচ্চারণের একটি মানদণ্ড তৈরি হয়ে গিয়েছিল। স্যারের দীর্ঘদেহী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উপস্থিতি ক্লাসে একধরনের স্বাভাবিক শৃঙ্খলা বজায় রাখত। তিনি শারীরিক শাস্তির পরিবর্তে তাঁর জ্ঞান এবং ব্যক্তিত্বের প্রভাব দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। এটি ‘Authoritative Teaching Style’-এর একটি চমৎকার উদাহরণ, যেখানে শিক্ষক ছাত্রদের প্রতি স্নেহশীল কিন্তু একই সাথে নিয়মের প্রতি কঠোর থাকেন।
মদন মোহন কুমার স্যার: বকুনির আড়ালে স্নেহ
মদন মোহন কুমার স্যার ইংরেজি গ্রামার পড়াতেন, আর তাঁর বকা দেওয়ার ভঙ্গি ছিল কিংবদন্তিতুল্য। “একটারও চেহারা সুন্দর নাই” বা “ভূতের মত চেহারা”-এর মতো আপাতদৃষ্টিতে অপমানজনক কথা শুনেও ছাত্রছাত্রীরা হাসি সামলাতে পারত না।
বিশ্লেষণ:
স্যারের এই আপাত কর্কশ আচরণের পেছনে ছিল গভীর স্নেহ এবং একটি মনস্তাত্ত্বিক কৌশল। তিনি জানতেন, কৈশোরের ছাত্রছাত্রীরা সরাসরি উপদেশের চেয়ে অনেক সময় পরোক্ষ বা ভিন্নধর্মী আচরণে বেশি প্রভাবিত হয়। তাঁর এই অদ্ভুত বকুনিগুলো ক্লাসের একঘেয়েমি দূর করত এবং শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটি সহজ সম্পর্ক তৈরি করত। শিক্ষার্থীরা তাঁকে ভয় পেত, কিন্তু সেই ভয়ের মধ্যে কোনো ঘৃণা বা বিতৃষ্ণা ছিল না, ছিল একধরনের অধিকারের সম্পর্ক। তারা বুঝত, এই বকুনি তাদের ক্ষতি করার জন্য নয়, বরং মনোযোগ আকর্ষণের একটি কৌশল মাত্র। এর মাধ্যমে তিনি একটি চাপমুক্ত পরিবেশে গ্রামারের মতো নীরস বিষয়কেও আকর্ষণীয় করে তুলতেন।
আরতি মিত্র দিদি: স্নেহের শাসনে মাতৃত্বের ছায়া
আরতিমিত্র আপার স্মৃতি প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছে একজন স্নেহশীলা শিক্ষিকার ছবি ফুটিয়ে তোলে, যিনি ছাত্রদের দুষ্টুমিতে উত্তেজিত হয়েও তাদের নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত থাকতেন। কাউকে শাস্তি দিয়ে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখার পর সে হারিয়ে গেলে তাঁর যে করুণ অবস্থা হতো, তাতেই তাঁর ভেতরের মাতৃত্বের রূপটি প্রকাশ পেত।
বিশ্লেষণ:
আরতিমিত্র আপার চরিত্রটি প্রমাণ করে যে, শিক্ষাদান কেবল একটি পেশা নয়, এটি একটি ব্রত। তাঁর আচরণে ‘Care-Based Pedagogy’ বা যত্ন-ভিত্তিক শিক্ষাদানের প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি শিক্ষার্থীদের কেবল রোল নম্বর হিসেবে দেখতেন না, তাদের প্রত্যেককে একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করতেন এবং তাদের নিরাপত্তার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। তাঁর শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতির মধ্যেও শাসন এবং স্নেহের এক অপূর্ব ভারসাম্য ছিল। ছাত্ররা তাঁর সরলতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে বিরক্ত করলেও তাঁর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কোনো কমতি ছিল না।
রহমান স্যার ও হানিফ স্যার: বিজ্ঞানের জগতে ক্লান্তিহীন অভিযাত্রী
বিজ্ঞান শিক্ষক রহমান স্যার ছিলেন একজন অক্লান্ত পরিশ্রমী মানুষ। হাতে লম্বা বেত নিয়ে পুরো ক্লাস দৌড়ে বেড়ানো এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান বোঝানোর জন্য তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে হানিফ স্যারের সঙ্গে তাঁর জুটি ছিল বিখ্যাত। ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদের ক্লাসে ছাত্রদের দুষ্টুমিতে ব্যাঙ পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এবং তা ধরার জন্য যে হুলুস্থুল কাণ্ড হতো, তা যেমন হাস্যরসাত্মক, তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ।
বিশ্লেষণ:
রহমান স্যারের পাঠদান পদ্ধতি ছিল ‘Kinesthetic Learning’ বা শারীরিক সঞ্চালনের মাধ্যমে শেখার এক জীবন্ত উদাহরণ। তিনি নিজে ক্লাসে সক্রিয় থেকে শিক্ষার্থীদেরও সক্রিয় রাখতেন। তাঁর দৌড়ঝাঁপ এবং বেতের ব্যবহার ছিল শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখার একটি কার্যকর উপায়। অন্যদিকে, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে ব্যাঙ পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি ছাত্রদের সম্মিলিত দুষ্টুমির পরিচায়ক হলেও এটি প্রমাণ করে যে, ক্লাসরুমের পরিবেশ কতটা প্রাণবন্ত ছিল। শিক্ষকেরা ছাত্রদের এই ধরনের আচরণে বিব্রত হলেও তাঁরা বিষয়টিকে ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতেন। এটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সুন্দর সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে ছাত্ররা দুষ্টুমি করার স্বাধীনতা পায়, কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করে না।
আজিজুল হক স্যার: সৌম্য অবয়বের আড়ালে এক দৃঢ় কারিগর
ভূগোল শিক্ষক আজিজুল হক স্যারের ভাবমূর্তি প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মনে এক সৌম্য ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে গাঁথা আছে। ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, সাদা টুপি ও দাড়ি, ফর্সা চেহারা এবং হাতে লম্বা বেত—এই ছিল তাঁর বাহ্যিক রূপ। কিন্তু তাঁর পাঠদানের দৃঢ়তা ছিল অতুলনীয়।
বিশ্লেষণ:
আজিজুল হক স্যার প্রমাণ করেছিলেন যে, ভূগোলের মতো বিষয়েও লেটার মার্কস পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন কঠোর অনুশীলন এবং অধ্যবসায়। মাত্র ৩ মিনিটে বাংলাদেশের নিখুঁত মানচিত্র আঁকার জন্য ৩৮ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীকে বাধ্য করার ঘটনাটি তাঁর শিক্ষাদান দর্শনের পরিচয় দেয়। তিনি ‘Rote Learning’ বা মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে ‘Mastery Learning’-এ বিশ্বাসী ছিলেন, যেখানে একটি বিষয় সম্পূর্ণ আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত তার পুনরাবৃত্তি করানো হয়। শত শত বার অনুশীলন আর ভাঙা বেতের হিসাব তাঁর সেই নিষ্ঠারই প্রমাণ। তিনি তাঁর নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে ক্লাসে হাস্যরসের সৃষ্টি করলেও তাঁর মূল ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যন্ত রাশভারী, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমীহ আদায় করে নিত। তিনি শিখিয়েছিলেন, যেকোনো দক্ষতা অর্জনের জন্য অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই।
কাশেম স্যার: বাঁশির সুরে শৃঙ্খলার পাঠ
পিটি স্যার হিসেবে পরিচিত কাশেম স্যার ছিলেন স্কুলের শৃঙ্খলার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আগে প্রায় এক মাস ধরে তাঁর বাঁশির সুরে পুরো স্কুল যে দৌড়াত, তা ছিল হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্পের এক বাস্তব রূপ।
বিশ্লেষণ:
কাশেম স্যারের এই অনুশীলন কেবল শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ছিল না, এটি ছিল দলবদ্ধভাবে কাজ করা (Teamwork), নির্দেশনা অনুসরণ করা (Following Instructions) এবং সম্মিলিত শৃঙ্খলার (Collective Discipline) এক চমৎকার প্রশিক্ষণ। তাঁর বাঁশির সুর ছিল একটি ঐকতানের মতো, যা সকল শিক্ষার্থীকে একসূত্রে বাঁধত। এই ধরনের কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
আলেফ হোসেন স্যার: গণিতের জাদুকর
গণিত শিক্ষক আলেফ হোসেন স্যারকে শিক্ষার্থীরা যেমন ভয় পেত, তেমনি শ্রদ্ধা করত। তাঁর অংক করানোর পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। তিনি প্রতিটি লাইন এমনভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে, তা একই সাথে ছাত্রছাত্রীদের কাগজে এবং মগজে গেঁথে যেত।
বিশ্লেষণ:
আলেফ হোসেন স্যারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল শিক্ষার্থীদের মুখ দেখে বোঝার ক্ষমতা—কে অঙ্কটি বুঝেছে আর কে বোঝেনি। এটি গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক অদৃশ্য মানসিক সংযোগের পরিচায়ক। মনোবিজ্ঞানে একে ‘Emotional Intelligence’ বলা হয়। একজন শিক্ষকের এই ক্ষমতা তাঁকে প্রতিটি ছাত্রের প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠদান করতে সাহায্য করে। তিনি কেবল গণিতের সমাধানই করতেন না, তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাণিতিক যুক্তি (Mathematical Reasoning) এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা (Problem-Solving Skills) তৈরি করে দিতেন। তাঁর ক্লাসে ভয় এবং মনোযোগের যে সংমিশ্রণ ছিল, তা গণিতের মতো কঠিন বিষয় আয়ত্ত করার জন্য অত্যন্ত সহায়ক ছিল।
আমাতুল মাওলা আপা: সৌন্দর্যের সাথে দৃঢ়তার মেলবন্ধন
আমাতুল মাওলা আপা ছিলেন আরেকজন গণিত শিক্ষক। তাঁর সৌন্দর্য যেমন শিক্ষার্থীদের মুগ্ধ করত, তেমনি হোমওয়ার্ক না করলে তাঁর বেতের প্রয়োগ তাদের শঙ্কিত রাখত।
বিশ্লেষণ:
আমাতুল মাওলা আপার চরিত্রটি প্রমাণ করে যে, সৌন্দর্য ও কঠোরতা একসাথে চলতে পারে। তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছিলেন যে, বাইরের রূপ যাই হোক না কেন, কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং শৃঙ্খলার কোনো বিকল্প নেই। হোমওয়ার্ক বা বাড়ির কাজ দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো, ক্লাসে যা শেখানো হলো তা বাড়িতে অনুশীলন করে স্থায়ী করা। এই অনুশীলনে অবহেলা করলে যে শাস্তির বিধান ছিল, তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করত।
সন্তোষ স্যার: সাহিত্যের বাতিঘর
বাংলা এবং বুককিপিং-এর শিক্ষক সন্তোষ স্যার ছিলেন একজন সাহিত্যরসিক মানুষ। তিনি পাঠ্যবইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বিশাল সাহিত্য জগতের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিতেন।
বিশ্লেষণ:
সন্তোষ স্যারের অবদান ছিল সুদূরপ্রসারী। তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্যপাঠের যে আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিলেন, তা তাদের মননকে সমৃদ্ধ করেছে এবং জীবনকে দেখার একটি নতুন perspectiva দিয়েছে। তিনি কেবল পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য পড়াতেন না, তিনি পড়াতেন জীবনের জন্য। তাঁর ক্লাসগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা (Critical Thinking) এবং নান্দনিকতাবোধ (Aesthetic Sense) তৈরিতে সহায়তা করেছে। বহু শিক্ষার্থীর সাহিত্যিক হওয়ার পেছনে বা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী হওয়ার পেছনে তাঁর মতো শিক্ষকদেরই নীরব অবদান থাকে।
মিলন কান্তি স্যার: সুরের ভুবনে হাসিকান্নার পাঠ
সংগীত শিক্ষক মিলন কান্তি স্যার ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের একজন নিয়মিত শিল্পী। তাঁর ক্লাস ছিল সুর, তাল ও লয়ের পাশাপাশি নানা মজাদার ঘটনায় পরিপূর্ণ। হারমোনিয়ামের ছবি এঁকে নিয়ে যাওয়া বা ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানের স্মৃতিগুলো প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কাছে অমূল্য।
বিশ্লেষণ:
মিলন কান্তি স্যারের ক্লাস প্রমাণ করে যে, শিক্ষা মানেই সবসময় গম্ভীর পরিবেশ নয়। হাস্যরস এবং মজাদার ঘটনার মাধ্যমেও শেখা যায়। হারমোনিয়ামের ছবি আঁকার ঘটনাটিতে তিনি ছাত্রটিকে বকা দিলেও পুরো ক্লাসে যে হাসির রোল পড়েছিল, তা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার এক ভিন্ন প্রকাশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আবার, এক ছাত্রকে দিয়ে বারবার একই লাইন গাওয়ানোর ঘটনাটি হয়তো সেই ছাত্রের জন্য বিব্রতকর ছিল, কিন্তু এর মাধ্যমে স্যার হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, সংগীত সাধনার বিষয়, শখের নয়। তাঁর ক্লাসগুলো শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক মনন গঠনে এবং তাদের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা অন্বেষণে সহায়তা করত।
স্কুল জীবনের পর একই প্রতিষ্ঠানে কলেজ পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীরা আরও পরিণত এবং মননশীল শিক্ষকদের সান্নিধ্য লাভ করেন। এই শিক্ষকেরা কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আরও পরিণত স্তরে মতবিনিময় করতেন।
মাহবুব স্যার: বাংলার জাদুকর ও একুশে পদকপ্রাপ্ত কিংবদন্তি
কলেজে বাংলা পড়াতেন মাহবুব স্যার। তাঁর ক্লাস সম্পর্কে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হলো, তাঁর এক অসাধারণ মোহনীয় ক্ষমতা ছিল। ভালো না লাগলেও কেউ তাঁর ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেত না, বরং মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। পরবর্তী জীবনে তাঁর ‘একুশে পদক’ প্রাপ্তি সেই মোহনীয় ক্ষমতারই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
বিশ্লেষণ:
মাহবুব স্যারের পাঠদান ছিল শিল্পের পর্যায়ে। তিনি ভাষার জাদুতে শিক্ষার্থীদের সম্মোহিত করে রাখতেন। তাঁর বাচনভঙ্গি, বিষয়বস্তুর গভীরতা এবং উপস্থাপনার মুনশিয়ানা বাংলা সাহিত্যকে শিক্ষার্থীদের কাছে এক জীবন্ত অধ্যায় হিসেবে তুলে ধরত। তাঁর একুশে পদক প্রাপ্তি কেবল তাঁর ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজের জন্যও এক বিশাল গৌরবের বিষয়। এটি প্রমাণ করে যে, এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে একেকজন দিকপাল। তাঁর মতো একজন কিংবদন্তির সরাসরি সান্নিধ্য পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল এক অমূল্য অভিজ্ঞতা, যা তাদের জীবনকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছে।
মাইনুল হাসান স্যার: ইংরেজি সাহিত্যের আধুনিক রূপকার
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ইংরেজি পড়াতেন মাইনুল হাসান স্যার। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, পরিচ্ছন্ন পাঠদান এবং বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ছিল শিক্ষার্থীদের কাছে ভীষণ প্রিয়। O. Henry-র ‘The Gift of the Magi’ গল্পের ‘Jim and Della’-র চরিত্র দুটিকে তিনি যেভাবে ক্লাসে উপস্থাপন করেছিলেন, তা আজও শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে আছে।
বিশ্লেষণ:
মাইনুল হাসান স্যার ছিলেন একজন আধুনিক মেন্টর। তিনি একদিকে যেমন তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে ক্লাসে শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন, অন্যদিকে টিফিন পিরিয়ডে ছাত্রদের সঙ্গে টেবিল টেনিস খেলে তাদের বন্ধু হয়ে যেতেন। তাঁর পাঠদান পদ্ধতি ছিল ‘Engaging and Interactive’। তিনি কেবল গল্পের কাহিনী বলতেন না, গল্পের গভীরে থাকা আবেগ, ত্যাগ এবং ভালোবাসার শিক্ষাকে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে পৌঁছে দিতেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, শিক্ষকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেও জ্ঞানার্জন সম্ভব এবং এই পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে ভয়ের চেয়ে বেশি কার্যকর।
জাহাঙ্গীর স্যার: হিসাববিজ্ঞানের কঠোর শিক্ষক
হিসাববিজ্ঞানের (Accounting) শিক্ষক জাহাঙ্গীর স্যার ছিলেন অত্যন্ত কঠোর এবং নিয়মানুবর্তী। তাঁর ক্লাসে তিন দিন অনুপস্থিত থাকলে আর ঢোকার অনুমতি পাওয়া যেত না এবং কথায় কথায় অধ্যক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার নিয়ম ছিল।
বিশ্লেষণ:
কলেজ পর্যায়ে, বিশেষ করে হিসাববিজ্ঞানের মতো পেশাদারী বিষয়ের ক্ষেত্রে এই ধরনের কঠোরতা অত্যন্ত জরুরি। জাহাঙ্গীর স্যার তাঁর পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পেশাদারিত্ব, নিয়মানুবর্তিতা এবং ধারাবাহিকতার গুরুত্ব স্থাপন করতেন। তিনি বোঝাতে চাইতেন যে, কর্মজীবনে সামান্যতম ফাঁকিবাজিরও কোনো স্থান নেই। তাঁর ক্লাস থেকে শিক্ষার্থীরা যে কেবল হিসাববিজ্ঞান শিখেছে তা নয়, বরং কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলা এবং দায়িত্ববোধের শিক্ষাও লাভ করেছে।
স্মৃতির শক্তি ও শিক্ষার উত্তরাধিকার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের এই স্মৃতিচারণ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সত্যিকারের পরিচয় তুলে ধরে। একটি প্রতিষ্ঠান কেবল তার ফলাফল বা কাঠামোর জন্য বড় হয় না, বড় হয় তার শিক্ষকদের আদর্শ, নিষ্ঠা এবং অবদানের মাধ্যমে। এই প্রবন্ধে আলোচিত প্রত্যেক শিক্ষক ছিলেন একেকজন স্বতন্ত্র কারিগর, যাঁরা ভিন্ন ভিন্ন ছাঁচে, ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে শিক্ষার্থীদের জীবন গড়েছেন। কেউ কঠোর শাসন দিয়ে, কেউ স্নেহ দিয়ে, কেউ হাস্যরসের মাধ্যমে, আবার কেউ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের শিখিয়েছেন।
তাঁদের সম্মিলিত প্রয়াসেই একটি সাধারণ স্কুল হয়ে উঠেছিল এক ‘আনন্দপুরী’। এই আনন্দ কেবল খেলাধুলা বা দুষ্টুমির আনন্দ ছিল না, এ ছিল জ্ঞানার্জনের আনন্দ, নতুন কিছু শেখার আনন্দ এবং একটি সুরক্ষিত পরিবেশে বেড়ে ওঠার আনন্দ। যে শিক্ষকেরা আজ বেঁচে নেই, যেমন—অধ্যক্ষ জাকের উল্লাহ স্যার, প্রধান শিক্ষক খায়রুল আলম স্যার, পারভেজ স্যার, জাহাঙ্গীর স্যার, আজিজ স্যার, সোলায়মান স্যার, সিরাজ স্যার এবং নূর আহমেদ স্যার, তাঁরা তাঁদের কর্মের মাধ্যমে অমর হয়ে আছেন হাজারো শিক্ষার্থীর হৃদয়ে।
এই স্মৃতিচারণ কেবল কয়েকজন মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নয়, বরং এটি একটি গভীর জীবনদর্শনকে তুলে ধরে। এই দর্শন অনুযায়ী, শিক্ষা কেবল যান্ত্রিক জ্ঞান বিতরণ নয়; এটি একটি মানবিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে এক গভীর আত্মিক সেতুবন্ধন রচিত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজের শিক্ষকেরা ঠিক সেই আত্মিক সম্পর্কই গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এ কারণেই বহু বছর পেরিয়েও তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা যখন স্মৃতির পানে ফিরে তাকায়, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক মায়াবী আনন্দপুরী। সেই আনন্দপুরীর প্রতিটি কোণে অমূল্য স্মৃতি আর জীবনব্যাপী শিক্ষার আলো মিশে আছে—যে আলো আজও তাদের পথ দেখায় এবং ভবিষ্যতেও পথ দেখাবে। তাঁদের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার শুধু জ্ঞান নয়, বরং তা হলো মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা এবং মানবতার এক চিরস্থায়ী আলোকবর্তিকা।
এ কারণেই বহু বছর পেরিয়েও তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা যখন স্মৃতির পানে ফিরে তাকায়, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক মায়াবী আনন্দপুরী। সেই আনন্দপুরীর প্রতিটি কোণে অমূল্য স্মৃতি আর জীবনব্যাপী শিক্ষার আলো মিশে আছে—যে আলো আজও তাদের পথ দেখায় এবং ভবিষ্যতেও পথ দেখাবে। তাঁদের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার শুধু জ্ঞান নয়, বরং তা হলো মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা এবং মানবতার এক চিরস্থায়ী আলোকবর্তিকা।
About The Author
Share this:
- Click to share on Facebook (Opens in new window) Facebook
- Click to share on LinkedIn (Opens in new window) LinkedIn
- Click to share on Threads (Opens in new window) Threads
- Click to share on X (Opens in new window) X
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window) WhatsApp
- Click to share on Telegram (Opens in new window) Telegram
- Click to print (Opens in new window) Print